poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তিন শতকের প্রাচীন অথচ
নব যুবতীর অপরূপ মুখ,
জ্বলজ্বলে চোখ, উন্নত বুক
বুকের সোনালি আঁচিল চকিতে
জাগে স্মৃতিপটে চোখ বুজলেই।
কাকে মনে পড়ে? কোন্ সে মানবী?যত দূর জানি, নয় সে সুদূর
বাগদাদ কিবা দ্বারকার কেউ।
সে আমার এই জন্ম-শহরে
থাকে তার প্রিয় সংসারে আর
আমি থাকি দূরে, মানে বহুদূরে
এই শহরেই কবিতাকে বুকে প্রবল জড়িয়ে।গৌরী নামের সেই যুবতীকে
হৃদয় আমার দিয়েছি যখন,
ছিলাম কি আমি যুবক তখন?
নয় তা মোটেই। তখন আমার
কেশর-সুলভ কেশের চূড়ায়
ধরেছিল পাক রীতি অনুসারে।তবুও আমাকে দিয়েছিলে তুমি
পুশিদা পুষ্প হৃদয়-তরুর।
সেই পুষ্পের সুগন্ধে আমি
স্বর্গের আভা পেয়েছি নিত্য।
অথচ এখন সেই আভা তুমি
কেন যে হঠাৎ নিয়েছো ছিনিয়ে! (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তুমিও ফিরিয়ে নিলে মুখ কম্পিত দ্বিধায়, নাকি
ঘৃণায় গিয়েছো সরে। কতকাল, বলো কতকাল
এমন সুদূরে তুমি সীমাহীন ঔদাস্যের জাল
ছড়িয়ে থাকবে সর্বক্ষণ? আমি কী ব্যাকুল ডাকি
তোমাকেই, আজ আর এমন প্রান্তর নেই বাকি,
নেই কোন নদীতীর কিংবা পথ, অথবা পাতাল
যেখানে যাইনি আমি তোমার সন্ধানে। অন্তরাল
নিজেই করেছো সৃষ্টি, আজ আমি ভীষণ একাকী।তোমার কার্পণ্য কেন মেনে নেবো? কেন যাবো ফিরে
ধূমল তৃষ্ণায় প্রস্রবণ থেকে জলপান বিনা?
এখনতো অন্য কেউ নগ্ন তোমার সত্তার তীরে
তুলছে ফেনিল ঢেউ নিরন্তর, তুমি সে উচ্ছল
আদিমতা বুনো অন্ধকারে উপভোগ করো কিনা
জানতে চাই না, শুধু চাই আমার তৃষ্ণার জল। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুমি নিজেকেই করছো আহত
অবিরত; বারণ করেছি তবু শোনো নি নিষেধ,
হিমাঙ্কের বহু ডিগ্রী নিচে জমে থাকে নানা খেদ।
নিজে দায়ী; অথচ আমাকে দিচ্ছো ঠেলে ক্রমাগত
দ্রুত ফ্যাসিবাদী ফুটোহীন গ্যাস চেম্বারের মতো
কুঠরিতে; পারছি না নিতে আর সহজে নিঃশ্বাস।
ফর্সেপ উপড়ে নিচ্ছে একে একে সকল বিশ্বাস,
অথচ হৃদয় জুড়ে জেগে আছে প্রণয়ের ক্ষত।আমি কি বুলেটপ্রুফ দেয়াল ভেবেছো? ঝাঁক ঝাঁক
গুলি এসে ঝরে যাবে, লাগবে না গায়ে কিছুতেই
একটি আঁচরও? হয়তো ভাবো লাস্যময়ী অবসরে
লোকটার হতচ্ছাড়া বুকে এক ফোঁটা রক্ত নেই;
ধুরন্ধর সাপ ভেবে কেবলি পিছিয়ে যাও। থাক
অবান্তর কথা, শেষে যাবোইতো অখ্যাত কবরে। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এখন তোমার ঘুম নিশীথের দিঘিতে নিটোল
পদ্ম আর তোমার নিদ্রিত যৌবনের পূর্ণিমায়
উদ্ভসিত বন্ধ ঘর। আমার চোখের পাতা জুড়ে
নেই আজ নিদ্রার কুসুম, জ্বালাধরা চোখ মেলে
কাটাই প্রহর, শুনি প্রতারক জ্যোৎস্নার প্রভাবে
স্তব্ধ নিসর্গকে অপ্রস্তুত করে আচানক কাক
ডেকে ওঠে। আমার খাতার পাতা অসমাপ্ত এক
চতুর্দশপদী বুকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছে মাতম।কখন যে ভাঙবে তোমার ঘুম পাবো নাকো টের,
যদি না জানাও টেলিফোনে; রাত পোশাকের ভাঁজে
ভাঁজে জমে স্বপ্নের ভগ্নাংশ। সেই কণাগুলি খুব
সন্তর্পণে পারব কি কুড়োতে বিহানে কোনো দিন
তোমার ঘুমের অন্তরালে, স্বপ্নে চিড় না ধরিয়ে?
তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি! (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কখনো দূর থেকে কখনো খুব কাছে থেকে
আমাকে আমার কবিতা সঙ্গ দ্যায়। অপরূপ গোসলের
পানি শীতল ধারায় ধুঁইয়ে দ্যায়
দেহমনের ক্লেদ নীল পদ্ম হয়ে ফুটি। আমার এই
জন্মান্তরকে কেমন করে নিরাপদে
রোদ বৃষ্টি অথবা আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব?আজ মধ্যরাতে, চাঁদ যখন নির্বাসনে
তারামণ্ডলী গা ঢাকা দিয়েছে বামপন্থী রাজনৈতিক
কর্মীদের মতো, যখন স্বৈরাচারীরা
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করে কিংবা নাক ডেকে ঘুমায়,
তখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি
আমার কবিতা বিষয়ে। এতকাল
যে ধারণার সঙ্গে লদকা লদকি করেছি অষ্টপ্রহর,
তাকে অন্ধকার স্রোতে বন্যা উপদ্রুত এলাকার,
লাশের মতো ভাসিয়ে দিতে
এতটুকু দ্বিধা করিনি।আমার কবিতায় থাকবে না সেই ভঙ্গি, যা
ভড়কে দেখে পাঠককে, যার ধাক্কায় পা হড়কে পড়বে
কবিযশঃ প্রার্থীরা কিংবা যার মর্মোদ্ধার
করার প্রাণান্তকর, চেষ্টা হোঁৎকা সমালোচকগণ
শেষটায় মাথা চুলকোতে চুলকোতে
ঘা করে ফেলবেন এবং এমন এক জগাখিচুড়ি, ফিসফিসে
থিসিস দাঁড় করাবেন,
যারা মাথামুণ্ড তারা নিজেরাও বুঝতে পারবেন না।
আমার কবিতার ভাষা কস্মিনকালেও
বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলির মতো হবে না, এমন শব্দাবলী
তাতে থাকবে না যাতে বারবার তাক থেকে
নামাতে হয় স্ফীতোদর অভিধান। আমার কবিতার ভাষায়
বেজে উঠবে দিনানুদৈনিক
জীবনযাপনের ছন্দ। আমার কবিতা অশালীন।
চলচ্চিত্রের নায়িকার কোমর আর নিতম্বের দুলুনি
অথবা লম্বা ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ
কিংবা কালো বোরখা ঢাকা জবুথবু ঢঙের বিরোধী,
আমার কবিতা সবে কামরুল হাসানের সেই
তন্বীর মতো যে ঢেঁকিতে ধান কোটে,
গভীর ইঁদারা থেকে শক্ত হাতে রশি টেনে
বালতি ভরা পানি তোলে গ্রীষ্মের দুপুরে
হাড়-কাঁপানো শীতের সকালে।আমার কবিতা, আমি ঘোষণা করছি,
কখনো স্বৈরাচারী শাসক, নষ্ট মন্ত্রী, ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ,
কালোবাজারি আর চোরাচালানিদের
সঙ্গে ফুলের তোড়া সাজানো এক টেবিলে ডিনার খেতে
প্রবল অনাগ্রহী, বরং গরিব গেরস্তের ঘরে
ভাগ করে খাবে চিড়ে গুড়। জেনে রাখুন
আমার কবিতা পুলিশের লাঠি আর
বন্দুকের উদ্যত নল দেখে দেবে না চম্পট।
আমার কবিতা নয় গালে ঘাড়ে পাউডার-বুলানো
বিদূষক কিংবা বিশুদ্ধ গোলাপি আমেজে মশগুল
বুলবুলের সুরমুগ্ধ ফুলবাবু,
আমার কবিতা জয়নুল আবেদিনের গুণ টানা মাঝি।
যার বেঁকে যাওয়া পিঠে ছড়িয়ে পড়ে
ঘামমুক্তো আর সূর্যাস্তের রঙ।আমার কবিতা গণঅভ্যুত্থানের চূড়ায় নূহের
দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে
চেগুয়েভেরার বয়ে যাওয়া
রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে
যারা ডুগডুগি বাজিয়ে
যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর-নাচ নাচায়
তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আবার কবিতা ফুঃ বলে
উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।
আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র
কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আত্মজীবনী।আমার কবিতা বেঈমান অন্ধকারের বুকে ঈগলের মতো
নখর আর চঞ্চু বসিয়ে ঠুকরে ঠুকরে
বের করে আনে ফিনকি-দেয়া আলো এবং
সেই আলোর ঝরনাধারায় শুচি, হয় শুচি হয়, শুচি হয়। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | সূর্যোদয় এখনও অনেক দূরে, অন্ধকার বটতলে
বসে থাকি অর্থহীন। বেশ কিছু পথ
চলা বাকি আছে হে আমার ভাই-বোন। চোখ খোলা
রেখে এ মুহূর্তে যাত্রাপথে পা বাড়াও দ্বিধাহীন।রাহেলা, ফাতেমা, রাধা, অনিমা, নঈম, শাহরুখ,
অনিল গৌতম, শোনো, এখনই গা ঝাড়া দিয়ে পথে
নেমে পড়। মনে দ্বিধা, আতঙ্ক, নিরাশা
কিছুতেই কখনও দিও না ঠাঁই, পা চালাও দ্রুত।তোমাদের প্রাণ হরণের পালা ওত পেতে আছে
নানা দিকে, পথে কাঁটা বিছানো বিস্তর-
এই তথ্য জানা আছে, তবুও সব অশুভের হিংস্র
থাবা ছিঁড়ে খুঁড়ে যেতে হবে উদ্দিষ্ট চাতালে।মানবীকে দাসীরূপে দেখলে অপার উল্লাসিত যারা, তারা
যতই প্রবল হোক, হোক অমানুষ,
তোমরা রাশেদা, মরিয়ম, উর্মিলা, অঞ্জনা, বীথি,
বিমল, অতীশ, অবিনাশ, ফরহাদ, হালিম, রিয়াজ দ্রুত
পা চালাও পরস্পর হাতে হাত রেখে,
পৌঁছে যাও কাঙ্ক্ষিত মিলন-ক্ষেত্রে, যেখানে মানবী,
মানব সমান অধিকারে বসবাস করে আর
সাগ্রহে সানন্দে গড়ে নিরুপাম শান্তিনিকেতন। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | পাঁচজন বুড়ো জ্যোৎস্নারাতে গোল হয়ে
বসে আছে একটি বিরান মাঠে বড়
চুপচাপ। কখনও চাঁদের দিকে তাকায়, যে যার
ভঙ্গিতে খানিক হাসে, চোখ বন্ধ করে, বিড়ি ফোঁকে
কখনও-বা। ফুরোলে বিড়ির আয়ু দূরে
ছুড়ে ফেলে দেয়। বহুক্ষণ আলাপবিহীন থাকে।আচমকা একজন বুড়ো স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে বলে, ‘তা’হলে কি
আমরা এখানে এভাবেই স্তব্ধতার
প্রতিমূর্তি হয়ে
আলাপকে বনবাস দিয়ে এই মাঠে শূন্যতাকে চুষে খাবো?’তার বাক্যে অন্যজন নড়েচড়ে বসে, বন্ধুদের
দিকে হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘তুমিও তো পাথরের
ধরনে নিশ্চুপ বসে ছিলে এতক্ষণ। শোনো ভায়া,
তুমি কিছু শোনাও যা আমরা অতীতে
শুনিনি। তা’হলে বুঝি কতটা তোমার দৌড়, মাথা
নুয়ে মেনে নেবো ঠিক তোমার সিদ্ধির জেল্লা ভায়া।‘
এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো যে প্রবীণ, দৃষ্টি মেলে
এদিক সেদিক দ্রুত তাকিয়ে আবার
নিমেষে দৃষ্টির ঝাঁপি বন্ধ ক’রে বলে, ‘শোনা ভাইসব, যত
কথাই বলো না কেন, এই দুনিয়ায় পুরনোকে পুরোপুরি
খারিজের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ষোলো-আনা নতুন কথার
আমদানি বস্তুত সম্ভব নয়। প্রাচীনের রেশ রয়ে যায় শেষতক।‘
অকস্মাৎ বিরান মাঠের বুক থেকে পাঁচ বুড়োর আসর
মুছে যায়। সতেজ, সবুজ ঘাস আর
দূরবর্তী গাছপালা-সব কিছু গায়েব এবং
ধোঁয়াটে একটি গোলকের চঞ্চলতা পরিবেশে
শূন্যতাকে সদ্যবিধবার
বুক-চেরা মাতম বানিয়ে আবর্তিত হতে থাকে!
(গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | শোকমূলক | এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
আছেন তো ভালো ? ছেলেমেয়ে ?’
কিছু আলাপের পর, দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে
বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে–
‘এই আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন,
পাথরের টুকরোর মতন
ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে
বছর-তিনেক আগে, কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।’
কী সহজে হয়ে গেলো বলা,
কাঁপলো না গলা এতটুকু,
বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস, চোখ ছলছল করলো না
এবং নিজের কন্ঠস্বর শুনে
নিজেই চমকে উঠি, কি নিস্পৃহ, কেমন শীতল ।
তিনটি বছর মাত্র তিনটি বছর
কতো উর্ণাজাল বুনে কেটেছে,
অথচ এরই মধ্যে বাজখাঁই
কেউ যেন আমার শোকের নদীটিকে কতো দ্রুত রুক্ষ চর করে দিলো।
অতিথি বিদায় নিলে আবারো দাঁড়াই
এসে ফটোগ্রাফটির মুখোমুখি প্রশ্নাকুল চোখে, ক্ষীয়মান শোকে।
ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান
চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।সংকলিত (শামসুর রাহমান) |
শামসুর রাহমান | সনেট | একান্ত আমার করে পাই না কখনো তাকে, তার
বৃত্তে আছে বহু কুশীলব, যারা ওর সিংহভাগ
সময় ওড়ায়, সহজে সে কলরবে সানুরাগ
মেতে থাকে। ফাঁপা, ফাঁকা, রঙচঙে সামাজিকতার
নানা ঢঙ পছন্দ করে সে; আমি স্বার্থপরতার
আগুনে বৃথাই পুড়ি, দেখাতে পারি না পোড়া দাগ
অন্তরের কাউকেই, দহনকে হৃদয়ের ফাগ
ভেবে এমন কি সে-ও পরিহাসে জিভে দেয় ধার।মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় একটি ফুৎকারে এই খেলা
পণ্ড করে দিই, ছিঁড়ে ফেলি মেকি জগতের জাল,
অথবা চুকিয়ে দিই জীবনের দেনা অগোচরে
বিষে কিংবা একটি ছোরায়। সরোবরে ছুঁড়ে ঢেলা
কাটাবো সময় না কি শক্ত হাতে সরিয়ে জঞ্জাল
তোমার জন্যেই বাঁচি বলে থেকে যাবো এ শহরে? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | দাঁড়িয়ে এক মহান উৎসবের মুখোমুখি। ভিড়, কোলাহল, আনন্দোচ্ছ্বাস,
আলোকসজ্জা ইত্যাদির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগে। এই
আনন্দ, এই হাস্যরোল কি স্পর্শ করছে না আমাকে? উদ্যাপিত হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী। আমাদের গৌরবের বিপুল সূর্যোদয় সারা দেশের
নরনারী এবং শিশুকে চুম্বন করছে। আমি সেই চুম্বনের স্বাদ পাচ্ছি আমার সমগ্র
সত্তায়। এখন আমি গোলাপ, বুলবুল, ভ্রমর এবং স্বর্ণলতাকে ডেকে আনতে
পারি এখানে। আমার ঈষৎ সঙ্কেতে ওরা কথা বলে উঠতে পারে, গাইতে পারে
অনিন্দ্য গান। ওদের ঐকতানে আজকের এই উৎসব পাবে স্বতন্ত্র মাত্রা। এই
তো ওরা উপস্থিত হয়েছে বরণীয় অতিথির মতো। ওরা আমার ইশারার জন্য
অপেক্ষমাণ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না ওদের। আমার ইঙ্গিত এখনি,
এই মুহূর্তেই, পৌঁছে যাবে ওদের কাছে। বেজে উঠবে বিউগল, ওস্তাদের
সেতার, রাখালের বাঁশি। আমার চোখ, আমার ওষ্ঠ, কাঁধ, বুক, দু’টি হাত
উৎসবের আলোয় উদ্ভাসিত, আমি রূপান্তরিত হচ্ছি একটু-একটু করে। আমি
কি এখন মিকেলেঞ্জোলোর গড়া কোনও ভাস্কর্য যা অপরূপ সৃজনশীলতায়
দেদীপ্যমান, জীবনের ছন্দে স্পন্দিত? আমি নিজেই এক অনন্য উৎসব, যেমন
গুণী সুরের ঝরনা বইয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে যান কোনও তান?
মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তী উৎসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, আমি
কি কথা বলাতে পারবো গত সিকি শতাব্দীকে? পঁচিশটি বছর কি ফোয়ারা হয়ে
উঠবে অপ্রতিরোধ্য উচ্ছ্বাসে? পঁচিশটি বছর কণ্ঠ থেকে কোনও কথা ঝরানোর
আগেই ঈশান কোণ থেকে এক খণ্ড মেঘ আমার ওপর ঝুঁকে বললো, “যে
মানুষটি একজন উৎকৃষ্ট মৃৎশিল্পীর মতো স্বদেশকে প্রতিমা করে তুলতে
চেয়েছিলেন, চার বছর অস্তমিত না হতেই তাঁকে গ্রাস করল তাঁরই সৃষ্টি!” আজ
উৎসবের আনন্দমুখর প্রহরে এই সত্য ভুলে থাকা অপরাধ, গ্রীবা বাড়িয়ে
বললো সরোবরের শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস। বাঁশবনের আড়াল থেকে গহিন গাঙের
ঢেউয়ে শব্দের মতো কণ্ঠস্বরে কে যেন বললেন, ‘দুর্ভাগা দেশে এরকমই হয়।
আমাদের কি মনে নেই তাঁর কথা, যিনি মানবগণের অন্তরে ভিন্ন এক রাজ্য
প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন? তাঁরই মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ
করা হয়েছিল গলগোথায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে। স্বর্নরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের
এই তো পুরস্কার।
সোনার বাংলা ছেয়ে গেছে গুণ্ডায়-নিখাদ গুণ্ডা, রাজনৈতিক গুণ্ডা, ধর্মীয় গুণ্ডা,
সাহিত্যিক গুণ্ডা আর সাংস্কৃতিক গুণ্ডার তাণ্ডবে উৎকৃষ্টগণ গা ঢাকা দিয়েছেন
অন্তরালে। তাঁদের কথামালা, পরামর্শ গড়াগড়ি যায় আবর্জনার স্তূপে, পশুর
মলে। প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন যেসব
লেখক তাঁদের কলম ছিনিয়ে নেওয়া ষড়যন্ত্র চলছে। রাজনীতি-বিদ্বেষী
বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক কেউ কেউ বস্তাপচা ধোঁয়াটে থিওরি কপচিয়ে কেউ
কেউ ধর্মীয় আখড়ায় ফতোয়া বিতরণ করে চমৎকার মশগুল। অনেকে আবার
‘ফুলচন্দন পড়ুক তাদের মুখে’ বলে ঢোলক বাজাচ্ছে ঋতুতে ঋতুতে।
যে-দেশে রজব আলী চাষির সানকিতে আজ কী শাদা কী লাল কোনও ভাতই
ফুটে থাকে না ফুলের মতো, রজব আলীর বউ রাহেলা ছেঁড়া শাড়ি পড়ে হি
হি কাঁপে শীতে যে-দেশে, যে-দেশে নাছোড় অপুষ্টিতে দৃষ্টি হারায় অগণিত
শিশু, যে-দেশে ফতোয়াবাজদের মধ্যযুগীয় উৎপীড়নে, পাথর ও দোররার
আঘাতে সিলেটের নূরজাহান এবং তারই মতো আরও কোনও কোনও বঙ্গ-
দুহিতার মৃত্যুকালীন আর্তনাদ রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, বেনো জলে
ভাসে, যে-দেশে ইয়াসমিনের মতো কোমল মেয়ে পুলিশের পৈশাচিক হি-হি
হা-হা ধর্ষণের পরে খুন হয়, সে-দেশে আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা
নিয়ে বুধবৃন্দ ও কবিকুলের বাহাস এক তুমুল তামাশা ছাড়া আর কিছুই মনে
হয় না। যে-দেশে নকল নায়কের স্তবে অনেকে মাতোয়ারা, ভুল নেতা নিয়ে
হৈ-হুল্লোড়, নাচানাচি যে-দেশে লক্ষণীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্রমাগত নীরব
নিষ্ক্রমণ, যে-দেশে শহীদ জননীর ভাবমূর্তিতে বিষ্ঠা ছুঁড়ে দেয় দালালের দল,
সে-দেশে কোনও উৎসব উদ্যাপন কেমন খাপছাড়া মনে হয়।
তবু মুক্তিযুদ্ধের, স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত মহান উৎসবের
বড়ো প্রয়োজন আমাদের। এই শহর, যাকে আমি আবাল্য ভালোবাসি, এই
স্বাধীন, প্রিয় শহর আমাকে ঠেলে দিচ্ছে বিপন্নতায়, বুঝিবা পাঠাতে চায়
নির্বাসনে, যেমন মহাকবি দান্তেকে পাঠিয়েছিল তাঁর নিজের শহর। চৌদিক
থেকে নিরাপত্তাহীনতার আঁকশি ঘিরে ধরছে আমাকে, তবু আমি আজও অসীম
সাহসে টিকে আছি আপন বসতিতে। এই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি এই
আলো-ঝলসিত শহরে পঁচিশ বছরকে কথা বলানোর আশায়। আমার চৌদিকে
প্রবল জনস্রোত। সুপ্রিয়া গৌরী, তুমি এসে দেখে যাও এই অতুলনীয়
দৃশ্যাবলি। আমি আজ ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে ডাকছি। আমাদের
এগিয়ে যেতে হবে সকল বাধা ডিঙিয়ে, পশ্চাৎপদতার কুহকের হাতছানি
এড়িয়ে নতুন সভ্যতার দিকে। বিজয়োৎসব আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে
অনির্বাণ মশাল। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | তিনজন আলেমের বেজায় সুনাম শুনে তাদের
সামনে হাজির হয়ে বড় বেশি
কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়লেন, যেন তিনি তাঁদের
একজন নিয়মিত মাইনে-পাওয়া খাদেম।
সেই আগন্তুকের শরীরে যে-জামাকাপড়
মাঝে-মাঝে কাঁপছিল বাতাসে।কারা যেন, মনে হল লোকটির,
চিৎকার ক’রে বলছিল,-
‘কেন পা রেখেছিস এখানে হতভাগা
দূর হ এক্ষুনি, ঠাঁই নেই তোর এখানে?’আখেরে তাকে যেতেই হ’ল সেখান
থেকে অপসারিত হয়ে। ভাবেনি সে, যারা গজল
রচনা করে, জয় করে হাজার
মানুষের মন, তারা এমন কঠোর, এমন
খেয়ালি হয়। তাদের খাদেম যারা তারাও কি
এমন এলোমেলো, আকাশের নীলিমায় ভাসমান?যে বিরূপ লোকটি শহুরে পরিবেশে নিয়ত
কবি ও কাব্যসিদ্ধ গুণীদের অবহেলা, কাব্যপ্রেমী লোকটি
শহরের রুক্ষতা, ধূসর অবহেলা পিছনে
ফেলে রেখে গ্রামাঞ্চলে জীবনের চাকা ঘোরানোই উত্তম।
দেখা গেল লোকটি কাঁধে কলস-ভরা
জল বয়ে নানা জায়গায় হেটে সামান্য
অর্থের বিনিময়ে বিলি করত তেষ্টা-মোটানো কিছু পানি
আর মনে-মনে তার উচ্চারিত হত স্রষ্টার কিছু নাম।অতঃপর অতি সাদাসিধে কাপড়-পরা
লোকটির ঘটি সাধারণ গ্রামবাসীদের নিকট
বড় পরিচিত, প্রিয় হয়ে ওঠে, তবে সেই লোকটি,
বলা যেতে পারে, আত্মীয়ের চেয়েও
অধিক বরেণ্য হয়ে ওঠেন। কেউ-কেউ ভাবেন,
তাদের প্রিয় জনটির উপর মধ্যরাতে ফেরেশতার ফুল ঝরে!আখেরে বেশ কিছুদিন পরে সেই পানি-বিক্রোতার
ফেলে-আসা শহরের চতুর্দিক ঝলসানো বিজ্ঞাপন
সাড়া তুলল সর্বত্র। নির্ধারিত বিকেলে
নানা দিকে বিভিন্ন দেশের বড় বেশি কবি এবং
কবিতাপ্রেমীদের আসর জমল পরোদমে,
নানা স্থানের নানা কবি আবৃত্তি করলেন কবিতা।মাথায়, কাঁধে আশ্চর্য নিখাদ জল কাঁধে বয়ে
যে-লোকটি গ্রামেগঞ্জে ঘুরেছে
এবং অবসরে আসমানে দৃষ্টি মেলে কাটিয়েছে,
সে বসেছিল ভিড়ের বেশ কিছু দূরে একা-‘এমন সময়
দূর থেকে, কী আশ্চর্য, নাম ধ’রে ডাক এল তার।
অবাক, বিচলিত সেই জন দৃষ্টি মেলে দিল আকাশে।বেশ কিছুক্ষণ চতুর্দিকে নানা শব্দের জন্ম হলে আখেরে
সেই জল-বিক্রোতাকে খুঁজে পেয়ে
তাকে একজন ধীমান তার সাধারণ গলায়
একটি অনন্য মালা দুলিয়ে তাকে বুকে জড়ালেন। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার দু’হাতে কিছু নেই, তবু কেন
লোকে বলে-প্রহরে প্রহরে
পায়রা ওড়াই আমি, নিষ্পত্র গাছের জীর্ণ ডালে
বসাই রঙিন ফুল, খটখটে তিরিক্ষি খরায় রিম ঝিম
বৃষ্টি আনি নির্মেষ আকাশ থেকে আর
মাঝ রাতে বানাই অভ্রের ঘর শূন্যের মাঝার?বাকপটু নই,
জিহ্বায় জড়তা ঝুঁকে থাকে সর্বক্ষণ, তবু কেন অক্ষরেরা
যখন তখন
ভ্রমের মতো তোলে গুঞ্জরণ মাথার ভেতরে,
বেরিয়ে আসতে চায় হুড়মুড় করে,
যেমন মুরগির ছানা, দর্বা খুলে দিলে পর ভোরে?যখন একাকী হাঁটি ফুটপাতে, আমার উপর
ঝরে মুঠো মুঠো রেণু। বিস্ময়ে তাকাই
এদিক ওদিক, কেউ নেই আশেপাশে,
বুকের ভেতর নিয়ে অচিন সুরভি হেঁটে যাই শৈশব স্মৃতির দিকে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত?
আমার স্মৃতির ঝোপেঝাড়ে
হরিণ কাঁদে অন্ধকারে,
এখন আমার বুকের ভেতর
শুকনো পাতা, বিষের মতো রাত।দ্বিধান্বিত দাঁড়িয়ে আছি
একটি সাঁকোর কাছাকাছি,
চোখ ফেরাতেই দেখি সাঁকো
এক নিমেষে ভাঙলো অকস্মাৎ।গৃহে প্রবেশ করবো সুখে?
চৌকাঠে যায় কপাল ঠুকে।
বাইরে থাকি নত মুখে
নেকড়েগুলো দেখায় তীক্ষ দাঁত।অপরাহ্নে ভালোবাসা
চক্ষে নিয়ে গহন ভাষা
গান শোনালো সর্বনাশা,
এই কি তবে মোহন অপঘাত?
কেউ কি এখন এই অবেলায়
আমার প্রতি বাড়িয়ে দেবে হাত? (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও দৃষ্টি।
তোমার এই দৃষ্টপাত
কী তেলেসমাত ঘটাতে পারে
জানে না আমার ঘরের টিকটিকি,
ফ্যানের ব্লেডে বসে-থাকা চড়ুই,
বাবুই পাখি আর বাগানে দোল-খাওয়া বুলবুল।তোমার পিতামাতা জানেন না কী গজ
লুকানো ঐ দৃষ্টিতে। তোমার ভাইবোন, পরিচালিকা,
যারা নিত্যদিন দেখছে তোমাকে, তারা কেউই বুঝতে পারে না
তোমার দৃষ্টিতে
কখন বয়ে যায় নক্ষত্রের স্রোত, কখন
তোমার চোখের বিদ্যুল্লতায় ঝলসে যায় একজন কবির হৃদয়।এই যে এখন ধীমান সম্পাদক প্রেসে পাঠাবার আগে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করছেন পায়রার বুকের মতো
আমার পাণ্ডুলিপি, তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়
তোমার দু’চোখ শিরাজের হাফেজের মদিরা-উচ্ছ্বল
পানপাত্র; প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে
সরিয়ে নাও তোমার দৃষ্টি। সেই সুরা
প্রাণ ভরে পান করতে পারি,
কিন্তু আমার বুদ্ধি ঢলে পড়ুক অস্তাচলে,
আমি চাই না; প্রেমের শপথ, আমি তা চাই না।প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও দৃষ্টি।
তোমার অতীত, তোমার বর্তমান,
শাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়া তোমার স্বপ্ন
আর তোমার জাগরণের বোধাতীত সেই দৃষ্টি।
প্রিয়তমা, আমার কাছ থেকে তোমার
দু’চোখ সরিয়ে নাও, যেন আমার বুক
চুরমার না হয়ে যায় ঝড়-ধ্বস্ত পাখির বাসার মতো,
যেন এক ঝটকায় উড়ে না যায় আমার নিরাপত্তার তাঁবু। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কে যেন আমাকে মাছে মত তেল ছাড়াই
ভাজছে ভাজছে ভাজছে হঠাৎ
কামারের হাপরের নিচে জ্বলজ্বলে পেটা লোহার কথা
মনে পড়ল আমার
এখন আমি বলা যেতে পারে টগবগে
আগ্নেয়গিরির তাপে ভয়াবহভাবে
ঝলসানো আদিম গুহামানবের মত
আমার ভেতর সেদ্ধ হচ্ছে কিছু বনমুরগী আর রাজহাঁসআমি আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে
প্রবেশ করেছি এক তন্দুরে
অঙ্গারগুলো তুতেন খামেনের মণিরত্ন হয়ে
নাচছে আমার চতুর্দিকেবলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে এক সুন্দরী
দাঁড়াল আমার সামনে
তার চুল লাল
চোখ লাল
স্তন লাল
লাল তার ঊরু আর নিতম্ব অগ্নিশিখা তার বগলের চুল
সেই লালচুল সুন্দরী আমার দুচোখে হৃদ্যতাবশত
সামনে ছুঁড়তে থাকে ত্রন্তার জ্বলন্ত রক্তজবা
দেখতে পেলাম সুন্দরীর শুধু একটিমাত্র স্তন এবং
তার সঙ্গী স্তনটি যে জায়গায় থাকার কথা সেখানে
জমাট হয়ে আছে বৃদ্ধার ফোকলা হাসি
অসহ্য উত্তাপের মধ্য থেকে
আমি বিকশিত হচ্ছি আগুন রঙের ফুলের মত
আমার মাথাটা এখন রবারের বেলুন
চিল বালিহাঁস আর ঈগলকে নিচে রেখে দিব্যি
উঠে যাচ্ছে ক্রমাগত উপরে উঠে যাচ্ছে
বেলুনের সুতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড়
এক ঝটকায় ঝরে গেছে আমার বয়স
যেমন খসে পড়ে পুরোনো দালানের চুনবালি
এখন আমি শিশু
বালিশের ফোকরে আটকানো আমার মাথা
ক’দিন ক’রাত্রি ধরে ক্রমাগত কখনো
এপাশ ওপাশ করছি ঝড়ে-পড়া নৌকোর মত
কখনো কতরাচ্ছি একজন রাগী ফেরেশতা
আমাকে ঘন ঘন চাবকাচ্ছে আগুনের চাবুক দিয়েব্যাপক দাবানলে আমার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ছে আমার
অন্তর্গত এক পড়শী
আমার সঙ্গে পুড়ছে প্যারাডিসো হ্যামলেট গীতাজ্ঞলি
ডাস ক্যাপিটাল বনলতা সেন পদ্মনদীর মাঝি
ইয়েটস-এর পত্রাবলি গোলাপসুন্দরী আর
আবদুল করিম খাঁর যমুনাকে তীরআমার মাথার ভেতরে আলতা বাদুড় চালতা বাদুড়
অসংখ্য বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি ঢোসকা মাতালের
পদধ্বনি মস্তানের বিলা আওয়াজ
আমি শুনতে পাচ্ছি সুন্দরবনের চিতাবাঘের অট্রহাসি
প্রসব যন্ত্রণাবিদ্ধ এক নারীর গোলাপী হাসি
আমি শুনতে পাচ্ছি
সেপিয়া রঙের বিবর্ণ ফটোগ্রাফগুলো থেকে বেরিয়ে এসে
আমার চেনা আত্মীয়স্বজন তারস্বরে
আমাকে ডাকতে শুরু করেছে আমি শুনতে পাচ্ছি
আমার আগেকার দিনগুলোর এক দয়িতা আমাকে চটকাচ্ছে
আর আমার গৃহিণীর নির্ঘুম অসহায় হাতে
জ্বরের চার্ট বাতিল শাসনতন্ত্রের মত কম্পমান। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এ-কথা নিশ্চয় তুমি কখনো ভুলেও বলবে না-
‘ভালোবাসতেই হবে, এই মুচলেকা লিখে দাও,
বলে আমি ভন্ ভন্ করেছি তোমার চারপাশে
নিরালায় বরং দিয়েছি স্বাধিকার তোমাকেই
আমাকে গ্রহণ কিংবা বর্জনের। যদি কোনোদিন
ইচ্ছে হয়, চলে যেও; কখনো কোরো না বিবেচনা
পরিণামে কী হবে আমার। চন্দনার ঠোঁটে পেলে
তোমার খবর, কবরের মাটি স্বেচ্ছায় ছোঁবো না।
আমার গায়ের তাপ যদি হয় এক শো পাঁচের
কিছু বেশি, তবু মূর্চ্ছা যাবো না, ঘুরবো স্বাভাবিক।
ট্রেনের টিকিট কেটে অন্য কোনোখানে পাড়ি দেয়া
যাক ভেবে খুব তাড়াহুড়ো করে হোল্ডল বাঁধি না।আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে আমি মরে টরে
যাবো না, স্বীকার করি। অন্তত তোমার কাছ থেকে
মিথ্যা বচনের সহযোগিতায় করুণার কণা
কুড়ানোর বিন্দুমাত্র সাধ নেই। নিন্দুকের দল
যা ইচ্ছে রটাক, তুমি বিব্রত হয়ো না এতটুকু।
মানুষ তাকেই ভালোবাসে যাকে ত্যাগ করে যেতে
পারে মূক যন্ত্রণায়। ভেবে নিও, আমার এ ক্ষীণ
পদচিহ্ন যা ছিল তোমার অনুগামী, ঘাসে ঢাকা
পড়ে গ্যাছে; আমার সম্মুখ হতে অপসৃত হলে
তুমি, ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলবে সকল কিছু,
এমন জপালে পাখি কান দিও না কস্মিনকালে।
কেবল মৃত্যুই পারে মেয়ে তোমাকে ভুলিয়ে দিতে। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | একটি গোলাপ স্বপ্নে মোহন ভাস্কর ফরহাদ
দেখেছিলো, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও তার ঘ্রাণ
নিবিড় থাকতো জেগে সর্বক্ষণ, এবং নিষ্প্রাণ
পাথর দেখাতো তাকে গাঢ় স্বপ্ন একটি নিখাদ
প্রতিমার; সে প্রতিমা নিজে এক নতুন বিষাদ
হয়ে দীপ্ত ভাস্করের সত্তাময় বলে অফুরান
কথা, ছেনী হাতে ফরহাদ শোনে নহরের গান
কান পেতে; সেই গানে নেই কোনো মিলন সংবাদ।আমারও জীবনে আজো মিলনের মুহূর্ত আসেনি।
আমার দৃষ্টিতে তার স্তন যুগল হয়নি উন্মোচিত,
সুস্মিত অধর তার অন্তরালে থাকে চিরদিন,
আমার দোতারা তার শরীর-মেঘনাকে কল্লোলিত
করবে কি কোনোদিন? হবে না বিস্রস্ত তার বেণী?
বিচ্ছেদ-মরুর জ্বালা বাড়ে চরাচরে সীমাহীন। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | বাড়িটা গভীর রাতে দেখেছিল বৃষ্টিপাত।
ওর সারা গায়ে বর্ষার তুমুল ছাঁট, খুব
হিসহিসে হাওয়া ক্রমাগত
ক্ষ্যাপাটে ছোবল মারে। মাঠের ভেতরে
অন্ধকারে একলা বাড়িটা আরও বেশি
বাড়ি হয়ে ওঠে,
যেন পৃথিবীর আদি বাড়ি
কংক্রিটের অরণ্যের সংসর্গ ছাড়িয়ে
এই মাঠে থিতু।
এ-বাড়ি ছোঁবে না কাউকেই;
কোনো গূঢ় কথা, কারো ছায়া
ধরে রাখবে না কোনো দিন।
কতকাল থেকে বৃষ্টি, রৌদ্র আর বাতাসে বাড়িটা
পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন আর
সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানী।
কখনো সে কারো কারো শৈশব অথবা যৌবনের নিমগাছ
এ বাড়িটা কার? জানা নেই। ডুমুরের
গাছটা এখনও
আছে কি দাঁড়ানো এক কোণে? বাসিন্দারা
লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে,
কেউ কেউ হয়তো খাচ্ছে কফি, কেউবা পুরানো কথা
টেনে আনে,
অন্যজন দেয়ালের দিকে চোখ রেখে
চেয়ারে ভাস্কর্য এক চুপচাপ, পায়ে রাগ টানা,
কান পেতে বৃষ্টি শোনে একা,
বলার কিছুই নেই তার। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | বনেদি ঘরের কেউ নই, বলা যায়
অত্যন্ত অগণ্য আমি। গোলাপ, রজনীগন্ধা অথবা চামেলি
কারো সমতুল্য নই, থাকে না আমার প্রতীক্ষায়
কখনো ড্রইংরুমে কোনো ফুলদানি
পায়ের নিচেই থাকি সবার এবং
পিঁপড়ে, পোকামাকড়েরা মাঝে মাঝে
করে খুনসুটি।
যখন যুবক যুবতীরা,
যাদের সত্তায়, প্রেম রঙধনু হয়ে
জ্বলে, যারা ঘাসের ওপর বসে, কথা
ফুরুলে তাকায় এ আমার একরত্তি
অস্তিত্বের দিকে; বুঝতেই পারো সামান্য ঘাসের
ফুল ছাড়া অন্য কিছু নই।
অথচ তোমরা আমাকেও নিশ্চিহ্ন করার প্রায়
সব আয়োজন শেষ করে
এনেছো বস্তুত।
খুব হালকা উড়ে উড়ে রঙের বাহার আর খুশি
ছড়িয়ে বেড়াই সবখানে।
এ আমার খেলা; যদি বলো
বাঁচার আনন্দ, মেনে নেবো তর্কহীন।
আমাকে ধরার জন্যে খুকুমণিদের
দল আর কখনো কখনো
খেয়ালী বয়স্ক মজাদার কেউ কেউ
নাওয়া খাওয়া ছেড়ে
আমার পেছনে ছোটে। আমি যে রঙিন প্রজাপতি
এ কথা নিশ্চয়
না বললেও চলে; জানি, ঘর,
বারান্দা, বাগান, ঝোপঝাড় আর মাঠ থেকে দ্রুত
আমার সকল রঙ মুছে ফেলবার
সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে
ফেলেছো তোমার দেশ-দেশান্তরে ধীমান বন্ধুরা!
আমি কারো সাতে পাঁচে নেই, তর তর
গাছ বেয়ে উঠি,
নেমে আসি ঘাসে বার বার, কখনো বা দালানের
ছাদে যাই, রোদ শুকি, ছায়া পান করি আর এদিক ওদিক
চোখ রেখে ছোটাছুটি করার খেলায়
মেতে থাকি। যতদূর জানি,
একবার এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ কবি আমার মাথাটা
চুলকিয়ে দেয়ার বাসনা
প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ছোট অসামান্য কবিতায়।
তোমরা আমাকে, এই কাঠবিড়ালিকে,
পৃথিবীর ঘ্রাণময় গাছের কোটর, রৌদ্রছায়া
থেকে মহরুম করবার বলিহারি
নেশায় মেতেছো।এই যে আমাকে দ্যাখো, নদী
নালায় সাঁতার কাটি, সর্বদা চাঞ্চল্যে ভরপুর,
কখনো কখনো মাছরাঙা
ছোঁ মেরে, ওপরে তুলে নিয়ে পরিপাটি
ভোজ সেরে নিতে চায়। প্রায় প্রত্যহই
জেলে জাল ফেলে
জীবিকার টানে, তোলে যতক্ষণ পারা
যায়, আমরাও বেঁচে থাকবার সাধ
নিয়ে করি বসবাস জলজ পুরীতে। আমাদের
সহজে সবংশে ধ্বংস করবার জন্যে লেগে গ্যাছো
আদাজল খেয়ে; ভাবি, পাবে কি নিস্তার
পদ্মা আর মেঘনার, তিস্তার, মিসিসিপি, গঙ্গা,
হোয়াংহো ভলগার মৎস্যকুল?ভোরবেলা আমার গানের সুরে ঘুম
ভাঙে তোমাদের,
আমার রঙিন পাখা থেকে ঝরে কত
স্বপ্নের মুকুল অবলীলাক্রমে, আমি
এবং আমার ঝাঁক ঝাঁক সঙ্গী মধুর সঙ্গীতে
ফাল্গুনকে ডেকে আনি, আশপাশ মুড়ে দিই, পুষ্পল সজ্জায়,
অথচ তোমরা আমাদের লুপ্ত করে
বিষাক্ত রাসায়নিক পদ্ধতির নিপুণ প্রয়োগে
বসন্তকে নিস্তব্ধ করার
নাছোড় চক্রান্তে নিয়োজিত।(সকলে মিলে) ঘাসফুল, প্রজাপতি, মাছ,
পাখি কি কাঠবিড়ালি, যাকে ইচ্ছে বিলুপ্তির দিকে
ঠেলে দাও; কোনো খেদ নেই।
এ এক ভীষণ পরিহাস,
স্বয়ং তোমরা নিজেরাই নিজেদের
নির্মুল করার কী ব্যাপক খর প্রতিযোগিতায়
লিপ্ত ইদানীং। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | নখ দিয়ে কুটি কুটি পারি না ছিঁড়তে আকাশের
ছড়ানো ত্রিপল কিংবা সাধ্য নেই পাহাড়ের চূড়া
নিমেষে গুঁড়িয়ে দিই, পোড়াই কোরিয়া হাসিমুখে,
ফোটাই সাধের ফুল ইচ্ছেমতো গোলাপ বাগানে
আর এক চুমুকে সমুদ্রের সব জল শুষে নিই
নিপুণ খেলার ছলে, পরাক্রান্ত সিমুমের ঝুঁটি
মুঠোর ভেতর ধরি, ঝরাই শ্রাবণ সাহারায়,
আম গাছে কালো জাম ফলাই চতুর কোনো শ্রমে,
সার্কাসের বিনীত পশুর মতো উঠবে বসবে
চন্দ্র-সূর্য তর্জনীর ইশারায় সাধ্যাতীত সবি।অকুণ্ঠ কবুল করি শিখিনি এমন মন্ত্র যার বলে
আমার বাঁশির সুরে শহরের সমস্ত ইঁদুর,
রাঙা টুকটুকে সব ছেলেমেয়ে হবে অনুগামী,
কৃতকর্মে অনুতপ্ত পৌরসভা চাইবে মার্জনী।
যে রুটিতে বুভুক্ষার শুক্নো ছায়া পড়ে প্রতিদিন,
হতে পারি অংশীদার তার সন্ধ্যার নিঃসঙ্গ কোণে;
যে অঞ্জলি পেতে চায় তৃষ্ণার পানীয়, কয়েকটি
বিন্দু তারও শুষে নিতে পারি শিকি জ্যোৎস্নার আলোয়
আত্মার ঊষর জিভে…অথবা যেমন খুশি পারি
আঁকতে স্বর্গের নকশা। বিশ্বভ্রাতৃত্বের বোল জানি
জীবনে বাজানো চলে, যেমন গভীর তানপুরা
গুণীর সহজ স্পর্শে মিড়ে মিড়ে অর্থময়, পারি
ঈশ্বরকে চমকে দিতে হৃদয়ের ধ্রুপদী আলাপে। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | শুভার্থীরা হামেশা আমার উদ্দেশে এইমতো
নসিহত বর্ষণ করেন, ‘মাথা গরম কোরো না হে,
যা দিনকাল পড়েছে,
একটু সামলে সুমলে চলো।
এমন কি যিনি আমার হৃদয়ে
হাল্কা সুমা রঙের ম্যাক্সি-পরা
শরীর এলিয়ে হাই তোলেন বিকেলবেলা,
পছন্দ করেন ঘাসফড়িং, সরোবর এবং
প্রবাল সিঁড়ির স্বপ্ন দেখতে,
তিনিও নিত্য আমাকে পরামর্শ দেন
অগ্নিবলয়ের পাশ কাটিয়ে
কুলফি বরফের মতো কবিতা লিখতে।
কারণ, যার মাথা গরম,
সে নিজে পোড়ে সর্বক্ষণ
আর যারা তার কাছের মানুষ,
তারাও পুড়তে থাকে, যেন চিতার কাঠ।
ঠাণ্ডা মাথায় যারা কাজ করে,
তাদের তরক্কির রোশনিতে
পাড়ার পাঁচজনের চোখ যায় ধাঁধিয়ে।
সফল আমলারা উপর-অলাদের
সঙ্গে আমড়াগাছি করে
এত উঁচুতে উঠে যান যে,
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারেন
আকাশ, হেঁটে যেতে পারেন
সুদূর মেঘের গালিচায়; কেননা,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাদের মাথা।
আর যারা খুন করে ঠাণ্ডা মাথায়,
তাদের বিজয় রথের গতি রোধ করবে,
এমন সাধ্যি কার?মাথা ঠাণ্ডা রাখতে যাদের জুড়ি নেই,
তারপর হরতালের সময় হয়
নানা ফন্দিফিকির এঁকে
অফিসে ছোটে,
নয় ভিসিআরে ফিল্ম দেখে আয়েসী
সময় কাটায়, হরতালীদের
মুণ্ডুপাত করে অষ্টপ্রহর, ব্রিজ কিংবা
তিন তাসের খেলায় মাতে,
অথবা আজ্ঞাবহ আদূরে কণ্ঠে ইনিয়েয় বিনিয়ে
কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে রুটিন মাফিক
নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি আর
স্বাধীনতা দিবসকে ডেকে নিয়ে যায়
নামী দামী নারী-পুরুষ শোভিত বঙ্গভবনের
দরবারে, বসায় শানদার সোফা এবং চেয়ারে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যাদের মাথা,
তারা কখনো ক্ষুদিরাম হয়ে
ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ায় না
স্বাধীনতার প্রত্যুষের মতো
মুখমণ্ডল নিয়ে।
মর্চে পড়া সমাজের হাহাকারে ওদের
হৃদয় এতটুকু কেঁপে ওঠে না।
দেশ যখন উত্তপ্ত তামার মতো,
তখন তারা আসাদ হতে পারে না,
হতে জানে না নূর হোসেন।ভাগ্যিস্, এই পোড়া দেশের
সব্বার মাথা এখনো একেবারে
ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি
হিমাগারে সংরক্ষিত শবের মতো। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এ-কথা সবাই জানে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস
ব্যতিক্রমী মত প্রকাশের দায়ে নিজহাতে বিষ
করেছেন পান কারাগারে। মৃত্যু উঠেছিলো নেচে
যখন সে প্রাজ্ঞ ওষ্ঠে কালো মোরগের মতো, বেঁচে
ছিলেন গৃহিনী তাঁর, ছিলো ছেঁড়াখোঁড়া সংসারের
স্মৃতিচিত্র, হাট-বাজারের সংলাপ, তরুণদের
নিয়ত সত্যাভিসারী দৃষ্টিপাত। তখন কি তাঁর
পড়েছিলো মনে এইসব খুঁটিনাটি? নাকি জগত সংসারকুটোর মতোই ভেসে গিয়েছিলো তন্দ্রাচ্ছন্ন স্রোতে?
অথচ সহজ ছিলো আত্মরক্ষা; যদি সত্য হ’তে
ফিরিয়ে নিতেন মুখ, তাহলে নিঃশ্বাস নির্বাসনে
যেতনা তখনই, আরো কিছুকাল নিকানো উঠোনে
পড়তো পদচ্ছাপ। সবই অধিবাস্তবের প্রহেলিকা
জেনেও নিলেন হেমলকী স্বাদ অকম্পিত শিখা। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | তিনি সূর্যাস্তেরই লোক; অবশ্য অজস্র সূর্যোদয়
সত্তায় রেখেছে জমা অন্তর্লীন আভা, ছড়িয়েছে
প্রাণবীজ পলে পলে তন্তুতে তন্তুতে আন্তরালে,
তবু অস্তরাগ
ডাক দেয় তাঁকে বারবার। এত যে কুহক আছে
সেই বর্ণময় নিরুচ্চার ডাকে, তিনিজানেন নি আগে।
বেশভূষা জীর্ণ আভিজাত্যের সুদূর ঘ্রাণে ভরপুর, চোখে
দেয়ালে দেয়ালে খোজে চিত্রমালা পূর্বপুরুষের। কখন যে
চোখের দিগন্তে মেঘ জমে ম্লান রক্তজবার মতন, প্রাণে
সুরেলা ধ্বনির প্রেত নেচে ওঠে, দর্পণে দর্পণে
প্রতিবিম্ব নানা দোলাচলে ভাসমান অপসৃত।
কখনো-বা ফ্রয়েডীয় লোকেনিজের অস্তিত্ব কী উদ্ভভট
ঘেরাটোপে ছায়াচ্ছন্ন দেখে চমকে ওঠেন খুব, বারবার
পালা ক’রে দ্বৈত সত্তা যায় হেঁকে কর্কশ প্রান্তরে,
কখনো নদীর বাঁকে কখনো অরণ্যে, কখনো বা
বালিয়াড়ি ঘেঁষে, চোরাবালিতে কখনো।রুমালে চাপেন নাক যখন তখন। পচা গন্ধে
টেঁকা দায় ভেবে নক্শাময় আলমারি খুলে তিনি
আতরের উজাড় শিশিটা নেড়ে চেড়ে হয়ে যান
দীর্ঘশ্বাস, দুর্গন্ধের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন ক্রমশ,
অথচ নাছোড় গন্ধ করছে বিব্রত তাঁকে রাত্রিদিন।
বুঝি এই স্বস্তি তাড়ানিয়াগন্ধ তাঁর অস্তিত্বেরই। তবে কি নিজেরই শব ব’য়ে
বেড়াচ্ছেন ভাবলেশহীন? ধ্বংস্তূপঅথবা পাখির
দগ্ধ বাসা চোখে পড়লেই স্বগৃহের কথা মনে পড়ে তাঁর।এখনতো চোখ নেই গ্রন্থের পাতায় কিংবা জরুরি দলিলে,
আপাতত নিসর্গের মিতালিতে নিস্পৃহ, কী এক
নিষ্করুণ শোভাযাত্রা দৃষ্টির সম্মুখে। দেখছেন অতিদ্রুত
গজাচ্ছে বিষাক্ত প্রাণীভুক গাছ বসতবাটির
চতুর্ধারে, আর পরগাছা ক্রমশ উঠছে বেড়ে
নিজেরই শরীরে তাঁর, কংকালের বুকে কাক জুড়েছে পাঁচালি।
বারান্দায় পায়রার ঝাঁক
বাজপাখি হয়ে তেড়ে আসে, নিরীহ পুতুলগুলো
হয়ে যায় ঘাতকের মতো অবিকল, দেখছেন
তিনি; শয্যাতল থেকে কতিপয় মৃত নীল হাত
শূন্য পেয়ালার দিকে কেবলি পৌঁছুতে চায়, পদহারা
জুতোগুলো নৃত্যপর চতুর্দিকে, কড়িকাঠে অসংখ্য যুবতী
দমবন্ধু ক্রূর অবেলায়উদ্বন্ধনে ভয়ানক নিষ্প্রভ এবং আশেপাশে
পুরোনো সিঁড়ির ধাপে বারান্দায় ছাদে দন্তহীন
বৃদ্ধেরা ক্রন্দনরত, উন্মত্ত শিকারী কুকুরের
পাল ক্রমাগত
খুঁড়ছে ঘরের মেঝে, তিনি দেখছেন। চোখে তাঁর
উৎসবমুখর নৌবহর ডুবে যাচ্ছে এবং বুকের মধ্যে
ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, জঠরে ক্রোধান্ধ বাঘ, রুক্ষ
মরুভূমি প্রসারিত ঘরে।আতংক বিলাস নয় তাঁর, বাস্তবিক
ভীতির পেরেকে কন্টকিত সত্তা, কবন্ধের দল
স্মৃতির ওপরে কুচকাওয়াজ করছে অবিরাম।
তিনি তো দর্পণ স্বকালের।শোনেন অবাক হয়ে কতো
নতুন শব্দের ঝাঁক, নব্য গায়েনের নীলাম্বর-ছোঁয়া স্বর
কেমন অস্বস্তিকর অথচ বাঁচার মীড়ে মীড়ে
ঝংকৃত পথের ধারে। কেউউ ‘সূর্যাদয় চাই’ বলে
চৌরাস্তায় আকর্ষণ করে ভিড় আর
বিষাদের প্রতিমূর্তি তিনিজনশূন্যতায় বন্ধ আপন প্রকোষ্ঠে
নিজেকে মেশান শুধু দূরগামী মেঘে, তিনি সূর্যাস্তেরই লোক। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কোথায় ফেলেছি বীণা, মনে নেই। মোটর বাইকে চেপে
দূটো মূর্তি দ্রুত ছুটে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আহত তরুণ কবি। আমি আর গেরস্তের ঘরে
পারিনা থাকতে, ছুটে যাই, চতুর্দিকে আসে ব্যেপে
লোকজন, আসবাবপত্র তছনছ আর কেঁপে
ওঠে রাজপথ, গূঢ় রহস্যের সচকিত স্তরে
হেঁটে যায় কে মোহিনী, গুহাহিত ক্ষুধিত প্রস্তরে
বারবার এলোমেলো মাথা কুটি কী কৃষ্ণ আক্ষেপে।আমার ইউরিদিকে হাসপাতালের কাছে এসে
মূর্ছা যায়, বীণা একপাশে মৃত পাখির মতন
পড়ে আছে। ইউরিদিকের চেয়ে বেশি ভালোবেসে
মৃত্যুরই গেয়েছি গান। নইলে কেন তাকালাম ফিরে?
এলোকেশী নারীসংঘ এসে আমাকে আক্রোশে ছিঁড়ে
ফেলে; দর্পণেরে করি আলিঙ্গন, স্বচ্ছ আলিঙ্গন। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আকাশে ওড়াই ঘুড়ি নানা রঙের ধাঁচের প্রায়
প্রতিদিন অনুরাগে; ওরা কোথায় যে চলে যায়
পরিযায়ী পাখিদের মতো, কোনো সন্ধান রাখি না
স্বভাববশত। একজন প্রবীণ সমাজতত্ত্ববিদ
অধ্যাপক হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন আমাকে দেখে-
কী অবাক কাণ্ড, লোকটা এ বয়সেও এই মতো
ছেলেখেলা নিয়ে মেতে আছে সারাবেলা আর ক’টি
যুবকও আঠার মতো দিব্বি তার সঙ্গে আছে লেগে।কখনো দিই না কান কারো কোনো মন্তব্যে, কেবল
ঔদাস্যের ভেলা বেয়ে চলি। গুণীজন লিপ্ত নানা
সমাজ-কাঁপানো কাজে, এই ব্যর্থ অকর্মণ্য আমি
নিজস্ব খেলায় মগ্ন। কখনো জ্বরের ঘোরে দেখি,
ইতস্তত পড়ে-থাকা আমার নির্মিত কিছু ঘুড়ি
মাঘের জ্যোৎস্নায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আগামীর কবি। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | দেখছি চৌদিকে থেকে কারা যেন ছুটে
আসছে দুরন্ত লাঠিসোঁটা নিয়ে হাতে
আমাদের বড় বেশি শান্ত,
নিঝুম পাড়ার দিকে। জানি না কী ক্ষতি
করেছি আমরা কোনকালে ভয়ঙ্কর উত্তেজিত,
ক্ষরু, অস্ত্রবাজদের! অকস্মাৎ মনে হ’ল, কিছু নেই কাছে।তা হ’লে কি ঘুমঘোরে দেখছিলাম দুঃস্বপ্ন কোনও?
ইদানীং কল্পনায় ডানাময়ী পরী
আসে না দূরের মেঘমালা থেকে এই শ্যামলীর
বেশকিছু বইময় ছোট এক ঘর,
চেয়ার, টেবিল আর বিছানা এবং টেলিফোন
ছাড়া কিছু নেই বটে। তবে দু’- একটি আরও কিছু আছে বটে।অকুণ্ঠ স্বীকার করি, ছোট এই ঘরটিকে প্রিয়,
বিশ্বাস্ত আশ্রয় ব’লে গ্রহণ করেছি-
বহুদিন হ’ল এর চার দেয়াল, জানালা, মেঝে
যতবার চোখে পড়ে, সত্যি বলি, বুকের ভেতর
কে যেন বাঁশির সুর নিঝুম ছড়াতে থাকে। আর
জ্যোৎস্নারাত পাশের গলিকে, কী আশ্চর্য, বেহেস্তের রূপ দেয়।আমার হীরা কি স্বর্ণ নেই, নেই কোনও চোখ দু’টি
ধাঁধালো মোটরকার। আছে শুধু একটি কলম,
গুণীজন কখনও সখনও এই লোকটির কলমের
প্রশংসা করেন বটে- তা নিয়ে থাকতে হয় কিছু শুষ্ক খুশি! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বলো তো তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব এতদিন
এ শহরে? শহরের পথ চেনে আমার নিভৃত
পদধ্বনি, কোনো পুরনো গলির মোড় জানে
আমার জুতোর গন্ধ কী রকম; এ চেনা নগরে
কিছুদিন তোমাকে কোথাও খুঁজে পাবো না নিশ্চিত।
তোমাকে না দেখে আর তোমার সুরেলা কণ্ঠস্বর
না শুনে থাকতে হবে ভাবতেই পারি না, অথচ
আমাকে দণ্ডাজ্ঞা মেনে নিতে হবে প্রতিবাদহীন!এখন শহর খুব বিপন্ন, আতঙ্কে কম্পমান;
শান্তি-ছাওয়া ছাত্রাবাসে নেকড়ের মতো হানা দেয়
জালিম পুলিশ, বুট লাথি মেরে হাওয়ায় ওড়ায়
ছাত্রের ভাতের থালা; বন্দুকের বাঁট ভেঙে ফেলে
হাত-পা নিদ্রিত শিক্ষার্থীর, ক্রুশবিদ্ধ মানবতা-
এরই মধ্যে, প্রিয়তমা, নিরন্তর তোমাকেই ভাবি। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।
ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা । |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | জাতিসংঘে অবিরল তুষার ঝরলে
পৃথিবীতে বসন্তের ফুল
চাপা পড়বে না।
বাংলাদেশে ভূমিহীন চাষীর সংসার
ছারখার হলেও নিশ্চিত
জাতিসংঘে প্রার্থনার ঘরে নিমগ্নতা
থাকবে অটুট।কে সুন্দরী ডলারের শূন্য মালা গাঁথে
স্বপ্নের গহনে?
নিউইয়ের্কের পূর্ণ সুপার মার্কেটে ঝলমলে
দ্রব্যের জগতে
মনে পড়ে, তাকে মনে পড়ে, নিগ্রো ঘেটোর মতন।
হৃদয় আমার অকস্মাৎ আর্তনাদ করে ঘোর অবেলায়।এখানে কী করে মনে পড়ে তাকে? কেমন নাছোড়
খাপছাড়া মন, তাই অবচেতনায়
চিত্রল হরিণ চিতাবাঘ, তার কী ফুল্ল শরীর
ভেসে ওঠে বারংবার। আমার দু’দিকে বাহরাইন, বাহামা
বার্বাডোস, পারমাণবিক ভস্মরাশি
কে ছড়াল
কোথায় কোন সে পাতালের
নির্জন অতলে,
নিঝুম সীমান্তে দিল হানা কারা উর্দি-পরা
তা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি। এরই মাঝে
সহসা সে উঠে আসে আফ্রোদিতির মতন
শরীরে স্বপ্নের ফেনা নিয়ে।মেশিন দলিল দস্তাবেজ সংঘ সংস্থা
ব্যক্তিকে নিয়ত টানে কী ধূসর নামহীনতায়।
জাতিসংঘ পরিণামহীন দেবতার মতো ডানা
ঝাপটায় শূন্যতায়। জাতিসংঘের ঠক বন্ধ
হলেও তৃতীয় বিশ্বে নবজাতকের নতুন চিৎকার বেজে
উঠবে নিয়ত, শীর্ণ হাত প্রসারিত হবে ক্রমে
সভ্যতার দিকে। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | (কবি-নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেশ্টের একটি কবিতা স্মরণে রেখে)তানভির আহমেদ খান, প্রতিষ্ঠিত, নামজাদা
লেখক, সাফল্যে তৃপ্ত, অন্ধকার বারান্দায় আজ
আছেন নিশ্চুপ বসে। মনের ভেতর তার কী-যে
তোলপাড়, জানে না দালান কোঠা, গলির জোনাকি।
তবে কি লিখতে না-পারার শুশুনিয়া মাঠ তাকে
করেছে ভীষণ গ্রাস? এইতো সেদিনও তার এক
পয়মন্ত গ্রন্থ হাটে বিকিয়েছে খুব, লেখনীকে
খরা আজো করে নি দখল। জাঁহাবাজ ফ্যাসিবাদী
গোষ্ঠী সদ্য করেছে প্রকাশ এক ঘাতক তালিকা;
সেখানে মুদ্রিত কতিপয় নাম, যেন সূর্যমুখী-
পরিচিত কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, বুদ্ধিজীবী
এবং সংস্কৃতিকর্মী, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ বান্ধব,
সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত, অথচ সেখানে তার
নাম নেই,তাই আজঅন্ধকারে মুখ রেখে তিনি
বড় বেশি বিচলিত। ‘তাহলে কি আমি, খ্যাতিমান
শব্দশিল্পী, এখনো যথেষ্ট নই প্রগতির পক্ষে?
করি নি কি অচলায়তনে প্রবল আঘাত কোনো?
এই যদি সত্য, তবে আমার সকল গ্রন্থ থেকে
শব্দ মুছে যাক, ওরা ঝাঁক ঝাঁক পতঙ্গের মতো
আগুনে মরুক পুড়ে। ইচ্ছে হয়, গ্লানি আর ক্ষোভে
চুল ছিঁড়ি, মাথা ঠুকি নীরেট দেয়ালে; ইচ্ছে হয়,
ফ্যাসিবাদীদের দরবারে নতজানু হ’য়ে বলি-
দয়া করে তালিকায় আমার নামটি লিখে নিন’। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ইচ্ছেগুলি থেঁতলে দিয়ে করলে এ কি?
চেয়ে চিন্তে কয়েক বিঘে দুঃখ নিলে?
দুঃখ-দুঃখ বেড়াল শুধু তীক্ষ্ম দাঁতে
মাংস ছিঁড়ে হৃদয় ফুঁড়ে ওষ্ঠে চাটে।
তার সে অঙ্গে সঙ্গ চেয়ে মনের ভেতর
মৎস্য হয়ে কেমন তুমি একলা হ’লে।তীষণ দগ্ধ দূর শতকী পাখির বাসা
স্বপ্নে কেন ভস্ম ছড়ায় বারে বারে?
বহুকালের উজান বেয়ে জ্বলজ্বলে তার
যুগল বাহু জড়ায় কেন স্মৃতির গ্রীবা?
শিরায় শিরায় এখনো কি জ্বলবে প্রদীপ,
উড়বে পায়রা হৃদয় জুড়ে অবিরত?এই শহরে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে
দেখলে হঠাৎ প্রচুর বেলা অস্ত গেল।
রৌদ্র-সেঁকা শিশিরভেজা জামা তুমি
ছেড়ে ছুড়ে বললে এবার ফিরতে হবে।
ফিরতে গেলেই যায় কি ফেরা? পায়ের নিচে
শুকনো পাতা, ব্যর্থ শিল্প কান্না জোড়ে।ইচ্ছেগুলি থেঁতলে তুমি সামনে গিয়ে
ক্লান্তভাবে খুললে মুঠি বেলাশেষে-
নেই তো কিছুই, কী-যেন সব ছাইয়ের মতো
পড়ছে ঝরে,বিষণ্নতা আসে ব্যেপে।
বিঘে কয়েক দুঃখে তুমি কেমন ফসল
তুলবে বলো? পঙ্গপালের শব্দ জাগে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ধারে কাছেই একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে,
সেখানে রোজ নিরিবিলি চাইতো যেতে।
কিন্তু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
ফটকে নেই দৈত্যপানা মুখের মানুষ,
কুকুর টুকুর নেইকো কিছুই;
সকালবেলা কিংবা কোনো রক্তজবা-কমান গোধূলিতে
কিংবা ঝোড়ো হাওয়ার রাতে সেই বাড়িতে
তবু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।সেই বাড়িতে থাকে যারা, নয়তো তারা শত্রু আমার।
তীক্ষ্ম ছুরি, কিংবা ধরো বিষের পাত্র
আমার জন্যে রাখে না কেউ।
কিন্তু তবু এই আমিটার সত্যিমিথ্যে
সেখানে হায় হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
সেখানে এক নিরুপমা বসত করে
চারদেয়ালের অন্তরালে।
সুরের মিহি নকশা দিয়ে সাজায় প্রহর মনের মতো,
শূন্যে ফোটায় রক্তগোলাপ হৃদয় যেন।
গাছের পাতায় আদর রাখে ইতস্তত।
শেখায় কথা কেমন সুরে দাঁড়ের সবুজ পাখিটাকে।
নিরুপমার ভোরের মতো হাসির ছটায়
দেয়ালগুল এক পলকে
উৎসবেরই নামান্তর।
কখনো ফের সেই বাড়িটা রাত্রিমাখা
উদাসী এক মেঘ হ’য়ে যায়
যখন সে তার কান্নাপাওয়া শরীরটাকে
দেয় লুটিয়ে শূন্য খাটে।
সিংদরজায় অদৃশ্য দুই পশু আছে,
তাদের মুখে লুপ্ত চাবি।
কোন্ খাবারে তৃপ্ত কেবা, নেই কো জানা;
তাইতো দুয়ার বন্ধ থাকে
এবং আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আড়ালে থাকার বাসনায় এই বিরূপ ঋতুতে
আমার নিজের ঘরে বসে আছি অত্যন্ত একাকী।
কোনো কিছু করার উৎসাহ নেই; বাইরে তাকানো
আছে শুধু মাঝে-মধ্যে আর আছে গোপন দহন।আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে সে, যাকে দ্বিধাহীন
হৃদয়ের নীল পদ্ম করেছি অর্পণ। আমার সে
জখমি হৃদয় থেকে ফোঁটা শোণিত ঝরছে।
চাই না করুণা কারো, আমাকে থাকতে দাও আজআমার নিজের মতো। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো
অভিযোগ নেই আর; আমাকে নিজেই সবচেয়ে
বেশি দগ্ধ করি, ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলি নিজের হৃদয়,
আমার অপনকার পোড়া দেহ দেখি নির্বিকার।তারপরও সতেজ বুক ভ’রে নিতে পারি,
কাব্যপাঠে মগ্ন হই, কখনো-সখনো লিখতেও
পারা যায় কিছু পদাবলী আর, কী আশ্চর্য, এর
পরেও গৌরীর কথা ভেবে রঙধনু হয়ে যাই! (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | নিঃসঙ্গ ছিলাম বসে সন্ধ্যারাতে পড়ার টেবিলে
ঝুঁকে, আচমকা
ন্যালাখ্যাপা এক লোক আমার সম্মুখে
দাঁড়ালো, যেন সে খুব অন্তরঙ্গ ইয়ার আমার।আমার আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই পাশের
চেয়ারে ত্বরিৎ ক’রে নিলো ঠাঁই আর জুড়ে দিলো
ঘনিষ্ঠ আলাপ, যেন দীর্ঘ দিনের আপনজন।
বস্তুত সে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলো নিমেষে আমাকে।আমি শুধু বিহ্বল দৃষ্টিতে অনাহূত অতিথির
দিকে চেয়ে থাকি আর মন দিয়ে
শুনি তার সব কথা, আমি কিছু বলতে গিয়েও
মূক হয়ে চেয়ে থাকি তার জ্বলজ্বলে দু’টি চোখে।অনাহুত আজব অতিথি অনর্গল কথা ব’লে
সময়কে ঋদ্ধ করছেন, মনে হয়।
কিছু কথা বুঝি তার, কিছু বোধের আড়ালে
থেকে যায়। অথচ অপূর্ব বাণী তার আমাকে উন্নত করে।রাত ক্রমে গাঢ় হতে থাকলে অচেনা অতিথির
কণ্ঠস্বর আরও বেশি অপরূপ, অপার্থিব হয়ে
ওঠে, ক্রমান্বয়ে আমি তার
ভক্ত হয়ে নিজের ভেতরে নতুনের আভাবোধ করি।
আচমকা রাত্রিশেষে নিজেকে কেমন
আলাদা, নতুন মনে হয়। অপরূপ এই
পরিবর্তনের রূপ সর্বক্ষণ জেগে থাকবে তো?
অধিক সৃষ্টির আভা জ্বলজ্বলে হয়ে উঠবে তো? (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | তোমরা আমাকে ঠেলেঠুলে ঢের নিচে
ফেলে দিতে চাও-
বুঝতে আমার খুব বেশি মুশকিল
হয় না, যেমন বেড়ালের হাসি ফোটে অন্ধকারে!তোমরা তো জানোই, কক্ষণও আমি কার
বাড়া ভাতে বালি
ছিটিয়ে নিজের বগলকে ঢোল ভেবে
অতিশয় মৌজে ঘরে নর্তন করব।এই তো এখন বসে আছি, কেউ নেই
ব’লে দৃষ্টি মেলে
নীরবে আমার দিকে, সে কি অকস্মাৎ
আমাকে হত্যার জন্যে লড়ছে হঠাৎ!
না, মিথ্যা আমার মনে কালো কিছু ছায়া
আমাকে সহসা
ভড়কে দেয়ার জন্য এসে পড়ছে এবং
আমি সেই ফাঁদে দ্রুত পা দিয়ে ডুবছি!জানালার বাইরে পুষ্পিত চাঁদ হাসিমুখে
তাকিয়ে রয়েছে
পৃথিবী এবং এই কবির দিকেই অপরূপ বদান্যতা
ছড়িয়ে, নন্দিত এই শহরের মহিমাবর্ধনে ঐকান্তিক। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | যে-রাত্রির পাস্টেরনাক দেখেছেন সাদা প্রান্তরের
বরফের স্তূপে, নেকড়ের ক্ষুধিত চিৎকারে ছেঁড়া
শূন্যতায়, সে-রাত্রি দেখিনি আমি এবং এখানে
আমাদের ফটকে জমে না।
অজস্র তুষার আর বরফ চিবানো আধ-পাগলা
মেয়ে বাগানের ভাঙা বেড়াটার ধারে
অথচ চৌকাঠে
মুচ্কি হেসে দাঁড়ায় না এসে সিল্কের রুমাল-বাঁধা
চুলে খোলা পায়।
একদার কুয়াশায় লীন কোনো পৌষের হিমেল
রাত আজও অস্তিত্বের গির্জের চূড়োয়
ঝরায় শিশির কণা মনে পড়ে সেই ছোট ঘরে
প্রথম প্রহরে তুমি পড়ছিলে ডাক্তার জিভাগো
একা, গায়ে পাৎলা কোট, নামহীন দূরত্বে আসীনা-
তখন তোমাকে সহজেই ভাবা যেত বিদেশিনী,
বলেও ছিলাম তাই। আর সেইক্ষণে অকস্মাৎ
নরম কাগজ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো পাস্টেরনাকের
সাদা রাত্রি, যেন
পড়ল ছড়িয়ে সবখানে, উদ্ভাসিত
আমাদের সত্তার জটিল গাছপালা।
বলেছিলে ‘শীতের প্রখর রাত্রি দিয়েছে নামিয়ে
আমাদের অন্ধখার হা-খোলা কবরে।
হয়তো চাঁদের প্রেত খানা-খন্দে উঁকি
দেবে ক্ষণকাল, ক্ষণকাল গোপনে রাত্রির কানে
দুল হয়ে থাকবে ঝুলে ক’টি চামচিকে
তৃতীয় প্রহরে। রাত্রিভর হিম হাওয়া বয়ে যায়
রক্তের ফেনিল হ্রদে আর বারবার কেঁপে ওঠে
অস্তিত্বের প্রচ্ছন্ন কংকাল।আমি তার উত্তরে বলেছি এই দাঁতে-দাঁতে লাগা
নীল জীবনকে তাপ দেবে বসন্তের
উদার জ্বালানি। দ্যাখো চেয়ে সৌন্দর্যের গাঢ় স্তবে
মুখর রহস্যময় নিঃসঙ্গ মানুষ। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কী আমার দখলে রয়েছে? কোন্ জমি আজ
ফসলসজ্জিতু বলা যায়, আমারই এলাকা? কোন্
নদীতীর, সাঁকো কিংবা বালুচর, তমালের বন
আমার নিজের? সেই কবে দূরে সাধের জাহাজ
ভাসিয়েছিলাম, মনে পড়ে। মাঝিমাল্লাদের গান
যেখানে শোনেনি কেউ-লোনা ঢেউ, জলচর প্রাণী,
দ্বীপস্থিত বৃক্ষ, শ্যামা, কেউ- সেখানে সন্ধানী
দৃষ্টি মেলে, মনে হয়, ফলিয়েছি অলৌকিক ধান।অথচ এখন, যতদূর চোখ যায়, দেখি শুধু
ফসলবিহীন মাঠ বুভূক্ষুর মতো করে ধু ধু।
তবে কি যথেষ্ট শ্রম করিনি কখনো? ফসলের
স্বপ্নই দেখেছি শুধু প্রতিদিন মোহন বিলাসে?
করিনি কর্ষণ অবিরত কিংবা নিজস্ব ক্ষেতের
পরাগাছা নিড়াইনি? তাই ক্ষেত ছেয়ে গ্যাছে ঘাসে? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ক’দিন তোমার আসা-যাওয়া দেখব না। হাওয়া এসে
আদর বুলিয়ে দেয় আমার সত্তায়,
রোদ এসে আবীর ছড়ায় সারা ঘরে, পাখি আসে
ভোরবেলা, গান গায় আনন্দের সুরে,
অথচ আসো না তুমি ক্ষণিকের জন্যেও এখানে;
আমিও পারি না যেতে তোমার নিবাসে।নিয়মের বেড়া লণ্ডভণ্ড করা সহজ তো নয়।
হে বন্দিনী,
ইচ্ছে হয়, সারা পথ হেঁটে গিয়ে খসিয়ে শেকল
তোমাকে বাইরে টেনে আনি, পরমুহূর্তেই দেখি
তোমার সম্ভ্রম ময়ূরের দৃষ্টি নিয়ে
তাকায় আমার দিকে, আমার ভেতরকার তেজী
পুরুষের আদিমতা মাথা নত করে।
ধুলো চেটে পড়ে থাকি।ক’টি দিন কেটে যাবে শেষতক। আমার বেলা যে
যায় কঠিনের সঙ্গে সংঘর্ষে, করুণ
সাঁঝে তুমি জ্বালো দীপ হৃদয়ে আমার। দীপশিখা
আমাকে দেখায় পথ বিভ্রমের গোলক ধাঁধায়,
পৌঁছে দেখি তোমার স্বর্ণাভ বাহু বরাভয় হয়ে
স্থাপিত সন্ধ্যায়। দৃশ্যাবলি ফুটে উঠে ঝরে যায়।দুঃসময় অন্ধ পাখি অতিকায়, কালো
ছায়া ফেলে আমাদের প্রেমের উপর, আমরাতো
ভিন্নতর ছায়া চাই, পুষ্পবৃষ্টি চাই
সুতীক্ষ্ণ কাঁটার আগ্রাসনে, চাই স্বাদু পায়েসান্ন
করাল কাহাতে। শুধু আমরা দু’জন নয়,
সবাইকে নিয়ে
খরায় অভীষ্ট ঝর্ণা তলায় আঁজলা ভরে
জলপায়ী হবো। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | বেশ কিছুদিন থেকে প্রেরণা ফেরারী; যেন আমি
লুণ্ঠিত কাঙাল, একা-একা
ঘুরি ইতস্তত দিশাহারা। এখন কোথায় গেলে
আবার উঠবো ভ’রে কানায় কানায়?আখেরে বনের চারু হরিণের নিকট গেলাম
দিনান্তের অস্বচ্ছ আলোয়। তখন সে
পাতা থেকে ঝ’রে-পড়া সপ্নের সবুজ
খাচ্ছিলো চিবিয়ে, চমকিত তাকায় আমার দিকে।আমি যে নিষাদ নই, অসহায় প্রার্থী একজন,
টের পায়, দোলায় শিঙের কারুকাজ,
ঝরে সৌন্দর্যের কণা চারদিকে। গূঢ় স্বরে বলে,
‘আজ নয়, অন্য কোনোদিন তুমি এসো পূর্ণিমায়।শান্তি নেই, নিদ্রাহীনতার অন্ধকার
টানেলে আমাকে এক বুড়ো
গেঁথে নেয় তীক্ষ্ণ শিকে, উল্টে আগুনে পোড়ায়
সারা রাত; ব্যর্থ শব্দ লেগে থাকে ঠোঁটে, মরা মাছি।পূর্ণিমায় বনে যাই, খুঁজি সেই হরিণের সানন্দ ভঙ্গিমা,
আমার পায়ের নিচে পাতা বেজে ওঠে,
হঠাৎ অদূরে দেখি প’ড়ে আছে ঝোপের কিনারে
জ্যোৎস্নার রঙের মতো কতিপয় হাড়। হরিণের?দ্যুতিময় কী যেন প্রবেশ করে আমার ভেতর
অকস্মাৎ, সৃজনের আলোড়নে হই
ক্রিসমাস গাছ, সব ঠোঁট থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি
মুছে যায়, যখন আমাকেগাছপালা, পাখি আর জোনাকিরা করে
সম্ভ্রমে কুর্নিশ, মেঘ এসে
আমার চরণ ছোঁয়, আতিথ্য জানায় নক্ষত্রের দরবারে,
অন্তরালে নেচে ওঠে স্বপ্নবৎ হরিণের হাড়। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমার চাতক-মন সেই কবে থেকে প্রত্যাশার
প্রহর কাটায় ধ্যানে, মাঝে মাঝে তার
কী খেয়াল হয়, টেলিফোন রিসিভার তুলে
বলে যায় এলেবেলে কথা,
যদিও ওপারে কেউ নেই শ্রবণের প্রতীক্ষায়। এই খেলা
কেন যে মাতিয়ে তোলে আমাকে প্রায়শ-এ বাধ্যতা।আমি কি প্রকৃত কোনও শুভ সংবাদের
আশায় নিজের সঙ্গে কৃষ্ণকায় এই বর্তমানে
ক্রীড়াপরায়ণ হয়ে উঠেছি এমন? মাঝে মাঝে
শুনছি কলিংবেল, ছুটে যাই হন্তদন্ত হয়ে। দরজাটা
খুলে দাঁড়ালেই স্রেফ খাঁখাঁ শূন্যতার
দেখা পেয়ে কিছুক্ষণ খুব স্তব্ধ হয়ে থাকি।সন্ত্রাসের ধ্বনি ভেসে আসে প্রতিদিন, চতুর্দিক
থেকে বাড়িঘর, ধুলো, মাটি, গাছগাছালি এবং
ল্যাম্পেস্ট, ওভারব্রিজ বমি করে হাহাকার আর
অমাবস্যা-রাতে অগণিত মৃতদেহ
মাথা নত করে হেঁটে যায়
কে জানে কোথায়! পথে বিকট গহ্বর!এই অন্ধকার, এই হাহাকার থেকে, হায়, নেই কি নাজাত
আমাদের? কতবার টেলিফোন তুলে
কেবল নিজের সঙ্গে অভিনয় করে যাব? এভাবেই
আপন সত্তার সঙ্গে অভিনয় করে যাব আর কতকাল?
আমি চাই পথে আজ প্রাণবন্ত সব মানুষের
আসা-যাওয়া, গাছে গাছে কোকিলের সুরের মহিমা। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার বাসার চতুর্দিকে দালান উঠছে ক্রমে
মাতব্বদের মতো মাথা উঁচু করে। ইদানীং
সচ্ছলতা, বোঝা যায়, শিস্ দিচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়।
অবশ্য একথা তত প্রাসঙ্গিক নয়; দশজন
আঙুল ডুবিয়ে ঘিয়ে বসবাস করলে টাটায় না
কখনও আমার চোখ। এ রকমভাবে অতি দ্রুত
দালান ওঠার ফলে আগেকার অনেক কিছুই
পড়ে না আমার চোখে আর। প্রতিদিন যে তরুণী
বারান্দায় দাঁড়াতো উদ্দাম চুলে, যেসব বালক
একটি প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলে হতো খুশি, আর
দেখতাম তালগাছে চিল, দাঁড়কাক, কতিপয়
ভিন্ন পাখি সহজে বিশ্রাম নিতো, তারা সকলেই
অদৃশ্য সম্প্রতি; দুঃখ হয়। ল্যাণ্ডস্কেপের সন্ধানে
এখন মনের অভ্যন্তরে আমি দৃষ্টি মেলে দিই। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | তা’হলে আমি কি আমার একালা ছেড়ে একলা
কোথাও চলে যাবো? বহুদূরে
খোলা মাঠে কিংবা উপবনে? গাছপালা দেখে,
পাখির গান শুনে কাটিয়ে দেবো সারা বেলা?এভাবেই কি মানুষের মুখ না দেখে প্রকৃতির
সৌন্দর্যে মজে থাকতে পারবো ? কী ক’রে আমার
ছয় বছরের দৌহিত্রীর মুখ না দেখে থাকবো
বহুকাল? না, এই শহরের ভিড়ভাট্রা, চুরি-চামারি, ডাকাতি
যতই হোক এই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও।
ভুলেও কোনও আস্তানা বাঁধবো না কখনও।কখনও কখনও ক্লান্তির সবগুলো নাছোড়
আঙুল চেপে ধরে গলা রাত দুপুরে,
যখন আমি তখনকার মতো লেখার পাট চুকিয়ে তিমিরে
শয্যায় আশ্রয় খুঁজি। দম বন্ধ হয়ে আসতে
চায়; উঠে বসে স্যুইচবোর্ড হাতড়াতে থাকি। স্যুইচ
চকিতে আঙুলের দখলে আসে, আলোকিত হয় কামরা।কে বা কারা আমার পথে বিস্তর কাঁটা বিছিয়ে
আমাকে রক্তাক্ত দেখে বিকট
ভঙ্গিতে নাচতে থাকে, ছড়া কাটে, থুতু ছিটোয়
আমার দিকে। নিশ্চুপ আমি হেঁটে যেতে থাকি উঁচিয়ে
মাথা অন্য কোনওখানে। অন্ধকারের কেল্লা নিশ্চিত
একদিন সুশীল, সুগঠিত, বিশাল মিছিলের স্লোগানে হবে বিলীন। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | অসুস্থ, অসুখী একজন বহুকাল
বিষাদের বুকে বুক চেপে স্তব্ধতার কানে কানে
ফিস্ফিসে স্বরে কথা বলে। বাচাল সে
নয় কোনোকালে; আঁধারকে জব্দ করবার সাধ
অন্তরীণ আর দুর্ভাবনার মক্ষিকা
তাড়াতে নারাজ। মাঝে-মাঝে মুঠো থেকে
ছেড়ে দ্যায় একটি কি দু’টি পাখি আর
রঙধনু মেখে নেয় বয়েসী শরীরে।
মাথার ভেতর তার ধোঁয়াটে আকাশ,
পাগলাটে চাঁদ, বুকে সপ্তর্ষিমণ্ডল চেতনায়
পূর্বপুরুষের স্বপ্ন, কলরব, অপরাধ,
আহ্লাদ, বিমর্ষ নৈঃশব্দ্যের গাঢ় শৈলী।সে জানে গোখরো তাকে ছোবল দেবেই,
তবু ওরা বিষধর সর্পকেই গলায় জড়িয়ে
নিতে বলে; মাথা তার শোণিতের ছোপে
রঙিন স্থাপত্য যেন, তবু কাঁটার মুকুট পরানোর খেলা। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে টেলিফোন করি,
কিছুতে পড়ে না মনে তার নাম। ফলে, রিসিভার
রেখে দিই; তারপর হঠাৎ আমার পরিবার
পরিজন, এমনকি আমার আত্মার সহচরী
নামহীন আমার নিকট। আমি যেন সেই তরী,
যার দিশা হারিয়ে গিয়েছে খুব ঘন কুয়াশার
আবরণে; আকস্মিক বিস্মরণে বাড়ে মনোভার।
তবে কি ভাঙছি আমি না জেনেই সযত্নে যা গড়ি?এ আমার কী হলো হঠাৎ? যাকে সকল সময়
দেখি, তাকে যদি প্রশ্ন করি, ‘কী তোমার নাম’, তবে
সে কি আজ আমার বিভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে ভয়
পাবে না? এবং গৌরী আমার দু’ চোখে অচেনার
ব্যাসকূট দেখে যদি দুঃখ পায়, তাহলে কী হবে?
আমাদের দু’জনের মধ্যে এ কেমন রুদ্ধ দ্বার? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।
জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।
আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধুগুলো রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
আমি বুঝি তোর শঙ্কা আগামী বিরহ বেদনার বন্ধু সুধাংশু
আড়াই যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা আত্মার সম্পর্ক -
এই বাস্তুভিটার সাথে আর একঝাঁক বন্ধুর ভালবাসা প্রাণঢালা।
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
কোথায় সেই কল-কাকলীতে মুখরিত সবুজ সুন্দর কাপালী-ভিটাটি বন্ধু সুধাংশু
দু’টি জীর্ণ-শীর্ণ ঘর চির-দুঃখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে আজ সেই কাপালী ভিটায়।
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।
তুই কি জানিস বন্ধু সুধাংশু
তোর বিদায়ে ভীষণ ব্যথা পাবে আমার ঐ ছ’বছরের অবুঝ বোনটি ‘নেহা’
কাটাবে কত সন্ধ্যা অধীর প্রত্যাশায়, সুধাংশু ভাইকে জড়িয়ে ধরবেঃ কোথায় চকলেটগুলা?
তবুও তোকে পালাতে হবে যে, এবার তুই পালা।
আরও জানি বন্ধু সুধাংশু
তোর ষোড়শী বোনটি ‘মিলা’ দুষ্টামির ছলে আর বলতে পারবে নাঃ আলমদা তুমি এত কৃপণ কেন?
চলো মেলায় নিয়ে, কিনে দিতে হবে সুন্দর একটি মালা।
তথাপি তোকে পালাতে যে হবে, এবার তুই পালা।
তোকে যে বলা হয় নি বন্ধু সুধাংশু
মিলা’র সহপাঠী আমার ভাইটি ‘রিপন’ বলছিল সেদিনঃ ভাইয়া মিলা’টা যা সুন্দর হয়েছে না!
বলে দিয়েছি ওকে, সুন্দরী মেধাবী মিলা বিশ্ব জয় করবে, তোর মতো গর্দভটি ওর দিকে তাকাবে না।
তোর হাতে যে সময় নেই বন্ধু, এবার তুই পালা।
মিলাকে যে বিশ্ব জয় করতেই হবে বন্ধু সুধাংশু
অসাধারণ সুন্দরী মেধাবী মিলার জন্য এক ধর্ষিত, অচ্ছুৎ, অভাগী নারীর জীবন
হবে মানবতার জন্য এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা।
তাই আমার কাতর মিনতি বন্ধু, এখনই তুই পালা। |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
হাতে জপমালা নেই, তবু
আমি তো তোমার নাম মন্ত্রের মতন
করি উচ্চারণ সর্বক্ষণ। যেখানে তোমার ছায়া
স্বপ্নিল বিলাসে
অপূর্ব লুটিয়ে পড়ে, সেখানে আমার ওষ্ঠ রেখে
অনেক আলোকবর্ষ যাপন করতে পারি, তোমারই উদ্দেশে
সাঁতার না জেনেও নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
গহন নদীতে নেমে যেতে পারি।
তোমার সন্ধানে ক্রোশ ক্রোশ দাউ দাউ পথ হেঁটে
অগ্নিশুদ্ধ হতে পারি, পারি
বুকের শোণিতে ফুল ফোটাতে পাষাণে।
যখন পাথরে হাত রাখি,
পাথর থাকে না আর অরূপ পাথর,
হয়ে যায় প্রতিমা তোমার।
যখন বৃক্ষের দিকে দৃষ্টি মেলে দিই,
বৃক্ষ হয় তোমার শরীর।
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায় এক বুক উপদ্রব নিয়ে থাকি,
ব্যাকুলতা বারবার সিঁদ কেটে ঢোকে,
হৃদয়ের ঘরগেরস্থালি, বনস্থলীলুটহ য়ে যায়
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায়, আমি তাই তুমি ছাড়া কারুর জন্যেই
পারি না অপেক্ষা করতে আর।ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার ওষ্ঠজাম, তুমি না থাকলে
আমার সকল চুমো যাবে বনবাসে,
তোমার অমন হাত স্পর্শ ক’রে ছুঁয়েছি স্বর্গের
মল্লিকাকে, তুমি চ’লে গেলে
আমার ছোঁয়ার মতো অন্য কোনো হাত থাকবে না আর।
এর পরও অনুরাগ নিক্তিতে মাপতে চাও, চাও
আমার পরীক্ষা নিতে নানা অছিলায়?আর কি ভোগ চাও? এক একে নির্দ্বিধায়
সবি তো দিয়েছি।
হৃদয়ের আসবাবপত্তর সবি তো
স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে চাই, তবু কেন যাবতীয়
সম্পদ আমার
ক্রোক করবে বলে নিত্য আমাকে শাসাও?
আমি তো তোমাকে সুখ দিতে চেয়ে কেবলি নিজের
অসুখ বাড়াই।মাটি ছুঁয়ে বলছি এখন,
এই বৃক্ষমূলে আমি শীর্ণ হই, অন্ন আনি নিজে,
কান্নায় ধোওয়াই পদযুগ।
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
আমার সম্মুখে তুলে ধরো বিষপাত্র,
নিষ্পলক দ্বিধাহীন নিমেষে উজাড় করে দেবো। |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ক’দিন একটানা আঁধিঝড়ের পর, পাখির নীড়-পোড়ানো
দহনে হৃদয় ঝলসে যাওয়ার পর আষাঢ়ের ঘন মেঘ নামে
আমার অন্তর ছেয়ে। তোমার হৃদয়-কূলের উদ্দেশে জোয়ারে
ভাসিয়েছিলাম যে-তরী তার চোখে কি তুমি আমার অথই
ব্যাকুলতা পাঠ করতে পেরেছিলে? সে-চোখের ভাষা
অস্পষ্ট দেখলে তুমি তোমার অন্তরের পুশিদা পাখিটিকে
জিগ্যেশ করে নিলেই পারতে। আমি তো রবীন্দ্রনাথের গান,
বিটোভেনের সিস্ফনি, স্বর্ণচূড়ার রঙ, ভ্যান-গগের ছবি,
সন্ধ্যার পাখির উড়ে-যাওয়া, মায় ঘাসের শিশিরে কী সহজে
তোমার বার্তা পেয়ে যাই। যা-কিছু সুন্দর তাতেই দেখতে
পাই তোমাকে। আহ্, কী চোখ-জুড়ানো রূপ।আষাঢ়ের প্রায় সন্ধ্যাপ্রতিম মন-কেমন-করা দুপুর।
বিছানায় শুয়ে পড়ছিলাম হাল আমলের কবিতার
বই; আমাকে খানিক চমকে দিয়ে টেলিফোনে বেজে
উঠল। ‘ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম নাকি’, তোমার কণ্ঠস্বর।
‘মোটেই না, আমি তো জেগেই আছি। ‘তবু অসময়ে
টেলিফোন করে ফেললাম বলে দুঃখিত। কেমন অস্থির
লাগছিল, তাই…,’ তুমি বললে কণ্ঠে ঝর্ণাধারা বইয়ে
দিয়ে। কী-যে বলছ তুমি, আমার সকল সময় তোমাকেই
অর্পণ করেছি। তোমার জন্যে আমার কোনও বেলাই
নয়, অবেলা, আমার স্মিত উত্তর। তুমি বললে, ‘তোমাকে
আমার মতো করে চাইছিলাম এই লগ্নে, তোমার কথা
আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিল নিমেষে। আমার অস্থিরতা
মিলিয়ে গেছে আষাঢ়ী মেঘে। এখন তুমি বিশ্রাম করো
কবি; ইচ্ছে হলে বই পড়ো কিংবা কবিতা লেখো; পরে
কথা হবে।
আমি চাই তুমি আমাকে জাগিয়ে তোলো সবসময়। পথ চলতে
যখন জড়িয়ে আসে আমার চোখের পাতা তখন তোমার কণ্ঠস্বর ক্লান্তিপ্রসৃত
জড়তা-কুয়াশা ছিঁড়ে ফেলুক। তোমার ডাক আমাকে ফিরিয়ে
আনুক ভুলভ্রান্তির চোরাটান থেকে, আমি চাই। চাই তোমার
কথার সেই মোহন স্পর্শ, যা গাইবে জাগরণী গান। একদিন তো
এমন আসবে, যখন আমার সত্তা জুড়ে নামবে রক্ত-জমানো
বরফের পানিভেজা হিমশীতল কালো চাদরের মতো এক দুর্ভেদ্য
নিদ্রা। হায়, সেই ঘুমপাথর তোমার অমন মধুর কণ্ঠস্বরের
আলোড়নেও নড়বে না কিছুতেই।আপাতত যাক সেদিনের কথা; এখন সে-কথার বিষপিঁপড়ে
তোমার অন্তরে ছড়িয়ে বিরূপতার কর্কশকাচে মুখ ঘষে রক্তাক্ত
হতে চাই না। আমাদের ভালোবাসার সন্তান এক ফুটফুটে স্বপ্ন, যে
কখনও রোদে, কখনও জ্যোৎস্নায় খেলছে, এখন এটাই হোক প্রিয় ভাবনা। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ভোর নেই, দ্বিপ্রহর নেই,
নেই সন্ধ্যা; হাঁটছি, হাঁটছি।
কখন যে বেলা শেষ হয়ে এলো
বস্তুত পাইনি টের। রাত্রি দাঁত, নখ বের করে
আমাকে খাবলে ধরে। কী ভীষণ যন্ত্রণার ফাঁদে
পড়ে কাতরাতে গিয়ে অসহায়, বোবা হয়ে থাকি।পথের ধূসর ধুলো, কালো
কাঁটা ক্ষিপ্ত, বেয়াড়া গাছের,
আমাকে খোঁচাতে থাকে আর
বেধড়ক রক্ত ঝরে অতিশয় ক্লান্ত শরীরের
নানা শিরা ছিঁড়ে-খাঁড়ে। গাছে-বসা কয়েকটি পাখি
ভীত স্বরে কেঁদে ওঠে, হায়, মানবের দুর্দুশায়।এই যে যাত্রায় আমি আজ
পদে পদে বিপর্যস্ত হয়ে
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি
রেখে ফের হাঁটছি, হাঁটছি, সে কি শুধু অবিরত
ব্যর্থতার ভস্মরাশি সত্তাময় গ্রহণের জন্যে?
যতই ক্লান্তির চাপ থাক, তবু এগোতেই হবে।ঐ তো দূরে যাচ্ছে দেখা চূড়া
অপরূপ আস্তানার, যার
প্রদীপের আভা মুছে ফেলে
দেবে অতীতের ভ্রান্তি, দুর্গন্ধ এবং হাহাকার।
সম্মুখে উঠছে ভেসে অগ্রসর তরুণ, তরুণী,
যারা হাতে আগামীর প্রদীপ, নিশান তুলে নেয়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি
করতে পারি কি এই বয়সেও? যদি
বলি, দু’তিনটি
ভাষার কতক বাক্য অর্থসমেত বলতে পারি,
লিখতেও পারি, মিথ্যা উক্তি হবে না তা। সমাজের
কোনও কোনও স্তরে সম্মানের কিছু উপঢৌকন মিলবে বটে।অথচ আমার প্রতিবেশী না হ’লেও
অচেনাও নয় যে পাখিটা
আমার নিঝুম বারান্দায় এসে বসে, চিঁড়া মুড়ি
দিলে মুখে তুলে নেয়, উড়ে চলে যায়
আমার অজানা কোনও জায়গায়। গায়ক পাখির
গীতসুধা পান করে তৃপ্ত হই, যদিও সুরের ভাষা নেই। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই
অশুভের সাথে আপোসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই।
এখনো জীবনে মোহন মহান স্বপ্ন চাই
দয়িতাকে ভালোবাসার মতোন লগ্ন চাই।
কবিতায় আমি তারার মতোন শব্দ চাই,
শান্তি এবং কল্যাণময় অব্দ চাই।
মল্লিকা আর শেফালির সাথে চুক্তি চাই,
সর্বপ্রকার কারাগার থেকে মুক্তি চাই।
মুক্তি চাই,
মুক্তি চাই। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশের বাড়িটা
দু’টি শাদা ডানা পেয়ে চকিতে উড়াল দেয় মেঘে;
একজন বুড়ো লোক শুয়ে আছে গাছের ওপর
কাঁথা মুড়ি দিয়ে, বিড়বিড় করে ঘুমের গুহায়।
আখরোট সদৃশ দরিদ্র বুড়ো স্বপ্নের ভেতর
মড়ার খুলিতে ঢেলে কিছু সর্পরস করে পান
অকাতরে; অন্ধ বাদুড়ের ঝাঁক তাকে ঢেকে ফেলে,
ধেয়ে ইঁদুরের দল ওকে আহার্য ঠাউরে নেয়।সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি কোমর অবধি কাদাজলে,
চতুর্দিকে বিষ্ঠা ভাসমান, এরই মধ্যে কতগুলো
কোমল, সুন্দর জলচর পাখি প্রফুল্ল সাঁতার
কাটে আর আমিও বাজাই বাঁশি কালো পানি কেটে
এগোতে এগোতে; দেখি লন্ড্রিতে বিশুদ্ধ ধোয়া সত্য
পতপত ওড়ে পথে, লোকজন দৃকপাতহীন। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | অনেকটা পথ একা হেঁটে যেতে-যেতে বড় ক্লান্ত
হয়ে যেন ঢ’লে পড়ি বালির লুকানো
মৃত্যুফাঁদে। গা বেয়ে শীতল
ঘর্ম-স্রোত বয়ে যেতে থাকে।
কী করি? কী করি?-প্রশ্ন বারবার
হানা দেয় অন্তরের একান্ত শোণিতে।এই যে এখানে আমি তোমার দুয়ারে ভোরবেলা,
দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যায়, গভীর
রাত্তিকে ভিখিরি হয়ে পড়ে থাকি একা,
সে শুধু ঝঙ্কৃত কিছু শব্দাবলি কাগজের বুকে
সাজানোর আকাঙ্ক্ষায়। তখন আমার
বুক চিরে রক্তধারা বয় ঢের সকলের অগোচরে।এখন এখানে ছোট ঘরে এক কোণে ব’সে
সফেদ কাগজে কালো কালির অক্ষর
দিয়ে প্রায়শই পদ্য লিখি-
সংসারে চালের হাঁড়ি শূন্য হয়ে এল
কখন, খেয়াল,-হায় থাকে না প্রায়শ।
অথচ বাগান, নদী, আকাশের তারা চোখে ভাসে! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে ।ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর- শেভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায় ।আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা । |
শামসুর রাহমান | সনেট | হঠাৎ আমার ভেলা ডুবে গেলো খর চোরাটানে
ভর সন্ধ্যাবেলা আর সাঁতারে অপটু আমি ঘোলা
জলের নিমর্ম পাকে জড়াতে জড়াতে অনবোলা
অসহায় প্রাণীর মতন ডুবি, ভাসি, কোন্ খানে
কোন্ নিরুদ্দেশে একা যাবো ভেসে অন্তিমে কে জানে।
হতিমধ্যে চতুর্দিকে থেকে ক্রুর হাঙর, হা-খোলা,
আসছে তুমুল ছুটে, হায় অচিরাৎ রক্তে গোলা
হবে জলস্রোত, চোখ বুজি; মরণ বল্লম হানে।কী আশ্চর্য, এ কোথায় অক্ষত শরীরে দৈববলে
শুয়ে আছি অপরাহ্নে হাত-পা ছড়িয়ে শূন্য তীরে
এ কোন শ্যামল দ্বীপে? কাষ্ঠখন্ড আঁকড়ে কৌশলে
আমি কি এসেছি ভেসে? চিতার চোখের মতো চাঁদ
জ্বলে দূর আসমানে, তাহলে এসেছো তুমি ফিরে?
তুমিই জাগর দ্বীপে? করেছো হরণ অবসাদ? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ‘এমন বৈভব আমি দেখিনি কখনো’, বলে এক পর্যটক
নগরের দীপ্র দরদালানের দিকে অনিমেষ
তাকান, করেন স্তুতি। দিকে দিকে বিস্ময়-জাগানো
নানা শিল্পে। প্রবীণেরা করেছেন জ্ঞানের সাধনা
আজীবন, মিলিত উদ্যোগে সভ্যতার
সৌধে রেখেছেন কিছু সৃষ্টির স্বাক্ষর। এ নগরে
তরুণ-তরুণী যারা, তারা গ্রন্থ-অনুরাগী; নিসর্গ, প্রযুক্তি,
প্রণয়, সৌন্দর্য, নীতি ইত্যাদির প্রতি
অর্ঘ্যদানে অনলস,-পর্যটক বিশদ জানেনএ কী হলো? অকস্মাৎ এ কেমন ভূকম্পন? সৌধ ভেঙে পড়ে,
বৃষ্টিপাত, অগ্নিবৃষ্টি। হাহাকার ওঠে
চতুর্দিকে; লুণ্ঠনে হত্যায় মাতে মাতাল দস্যুরা। এ নগরে
এরকম বর্বরতা অন্তরালে ছিল
ভেবে পর্যটক খুব বিমূঢ় বিহ্বল।
দর্শন, নৃতত্ত্ব শিল্প পেঁচার চিৎকারে লুপ্ত হয়
লহমায়; শেয়াল ও নেকড়েরা সদম্ভে রটায়-
‘কবন্ধের যুগ হলো শুরু প্রণতি জানাতে হবে মূঢ়তাকে।প্রতারিত পর্যটক ছায়া দেখলেই পেছনে দাঁড়ান সরে,
যেন তার দিকে তেড়ে আসে
মনোহীন হন্তারক। পাখিরা নিশ্চুপ বড়, নক্ষত্রমণ্ডলী ঢাকা পড়ে
ধূমায়িত অন্ধকারে, আর্থ ইতিহাস, শুধু জেগে থাকে পেঁচার চিৎকার। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
লগ কেবিনের বাইরে এলেই পর্বতমালা,
শুভ্র পাগড়ি-পরা কতিপয় সান্ত্রীর মতো
নিথর দাঁড়ানো। তুষারবন্দি হ্রদের সীমানা
পেরিয়ে সহসা ভেসে আসে দূর পর্বতী নিঃশ্বাস।
আমাকে জড়ায় সে কোন সুদূর মরুবাসিনী ছায়া!কাঠবিড়ালিটা কেবিনের দোরে মৃদু ছুটে আসে,
ভিনদেশী এক মানুষের দিকে কেমন তাকায়
আবার পালায়। মনে পড়ে দূরে ফেলে-আসা পথ,
মুখের ওপর চুলের প্লাবন, কালো রাত্তির-আলো করা হাসি।
আমার হৃদয়ে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!জায়গাটা গুণী কম্পোজারের সিম্ফনি যেন।
কফি শপে ভাসে নানা দেশী ভাষা। কারো কারো চোখে
চোখ পড়ে কারো। রুপালি চামচ প্লেটের বাজে আর
বাইরে এখন ঝলমলে দিন। মনে পড়ে সেই
বোস্টনে-দেখ কোন সে বিহানে ফুটপাতে একা
অন্ধ যুবার ত্র্যাকর্ডিয়ানে নিকেল-কুড়ানো সুর।
সত্তায় নামে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
সুকান্ত সেই কিশোরের মুখ করোটি আজকে
আমার টেবিলে করোটি কেবলি চেয়ে থাকে আর
বলে দ্যাখো ঐ কবরেও দ্যাখো পুষ্পের বিপ্লব।
যে যায় অমন উদাস একলা, সে কি একেবারে
একা একা যায়? যায় না কি তার সঙ্গে কিছুটা
আলোছায়া কিছু মনে-পড়া আর বিধুর বেহাগী রেশ?
আমাকে নাওয়ায় সে-কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!কখনো-সখনো ধূসর পূর্ব পুরুষের কালো গোরস্তানের
পাশ দিয়ে আমি শিস দিয়ে যাই, চমকে তাকাই
কখনো হঠাৎ। ছিলেন তো ওরা আটচালা ঘরে,
পুকুরে রোজানা
করতেন ওজু, মসজিদে ছিল যৌথ সেজদা।
পুকুরের দিকে
তাকাতেন আর দেখতেন কিছু মাছের রুপালি লাফ।
আমার ওপরে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!উদাস পুকুর এমন হিংস্র আগে কে জানত?
আমার পায়েও খেয়েছে সে চুমো, নিয়েছে আমার
নানা বয়সে মাথাটার ঘ্রাণ শত শতবার।
হঠাৎ কেন সে আমার বুকের কিশোরকে নিল?
মেটাতে তার সে উনিশ শতকী রহস্যময় খলখলে ক্ষুধা
আমাকেই কেন দিতে হ’ল ভোগ, দিতে হল ভোগ আজ?
আমার দু’চোখে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!ট্রেন থেকে মুখ বাড়িয়ে এবং গুডবাই হাত
নাড়তে নাড়তে চলে যাই আমি ছায়ার মতোই।
কোথায় যে যাই। আকাশের চাঁদ মাতালের চোখ,
আমার মগজে দাবানল আর সত্তার সব তন্তু ছিন্ন-
একটু শান্তি পাব কি কোথাও এমন দগ্ধ
পারিপার্শ্বেকে? সম্মুখে নেই ওয়েসিস কোনো, শুধু মরুভূমি
উগড়ে দিচ্ছে বিষধর সাপ আর নৃসিংহ দারুণ উগ্রতায়।
আমার নিয়তি সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া! (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যা কিছু দেখার দেখি আশপাশে যা কিছু দেখার
একা ঘরে খাটে শুয়ে কিংবা পথেঘাটে হেঁটে যেতে
যেতে দেখি, যা কিছু শোনার শুনি, সকালেও চা খেতে
খেতে, গ্রন্থাগারে ঠান্ডা এক কোণে সেই কবেকার
পুরোনো নইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, অস্থিসার
বস্তিটার অভ্যন্তরে, রেস্তোঁরায় খোশগল্পে মেতে
কত কী-যে শুনি এলেবেলে আর মগজের ক্ষেতে
সুনীল ফসল নিয়ে বলি এ জীবন ফক্কিকার।অথচ আমার যা বলার তা বলি ঠিক? সব
কিছু বলতে কি পারি? আমার মনের কিনারায়
নানা কথা অকস্মাৎ ধর্মঘটী শ্রমিকের মতো
বেরিয়ে আসতে চায় একরোখা, ঐ যে জমি যায়
দেখা বলে নীলকুর্তা নাবিকের মতো কলরব
করে উঠতে চায় ওরা বেলা অবেলায় অবিরত। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারি আদিম অরণ্যে
যেখানে অন্ধকারে মূল্যবান রত্নের মতো জ্বলে
পাশব চোখ, ভালুকের কশ বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে টাটকা মধুর ধারা।কিন্তু আমি যাইনে সেখানে, থাকি শহরে, আমার শহরে।
ঊর্ধ্বশ্বাস ট্রাফিকের ব্যস্ততায় বিজ্ঞাপনের মতো
ঝলমলিয়ে ওঠা হাসি
শিরায় আনে আশ্চর্য শিহরণ
মনে হয় যেন ঢক করে গিলে ফেলেছি
এক ঢোঁক ঝাঁঝালো মদ। আর প্রহরে প্রহরে
অজস্র ধাতব শব্দ বাজে আমার রক্তে,
যেন ভ্রমরের গুঞ্জন।আমার ছোট খুপরিতে ভোর আসে
ব্যালেরিনার মতো নিপুণ বিন্যাসে, আমি
মৃত কবিদের প্রাণবন্ত অক্ষরে ডুবে থাকি-
বেলা গড়িয়ে অবেলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।রাতে খড়খড়িটা খুলে দেখি
বুড়ো রাজমিস্ত্রির চোখের মতো ছানি-পড়া আকাশে
জ্যামিতিক চাঁদ শোনে তারার কথকতা, সেই মুহূর্তে
রহমত ব্যাপারীর রক্ষিতা হয়তো তার ক্লান্ত যৌবনটাকে
কুঁচকে যাওয়া পোসাকের মতো
এলিয়ে দিয়েছে রাত্রির আলনায়।কখনো দেখি, রাত্রির ফুটপাতের ধারে এসে জমে
সারি সারি উজ্জ্বল মসৃণ মোটর,
যেমন গাঢ়-সবুজ ডালে ভিড় করে
পাখির ঝাঁক সহজ অভ্যাসে। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যতদূর জানি এক ঝাঁঝালো যুবক বুড়ো সুড়ো
এই ক্ষয়া আমার ভেতরকার নিভৃত বাসিন্দা
অনেক বছর ধরে। বসে থাকে, ঝাঁকায় দীঘল
কেশর শিং মাঝে মাঝে আমাকে থামিয়ে আওড়ায় পঙ্ক্তিমালা।যুবকটি আমার গহন থেকে নিঝুম বেরিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে গলিপথে নেমে
হেঁটে হেঁটে প্রধান সড়কে চলে যায়,
যেতে থাকে, যেতে থাকে উদ্দেশ্যবিহীন।কখনও বাতাসে চুল ওড়ে তরুণের, কখনও বা
রোদের কামড়ে তার গায়ের চামড়া পুড়ে যায়, স্নেহ চায়
লাজুক জ্যোৎস্নার। নেই কোনও বান্ধবের
আস্তানা কোথাও কিছুক্ষণ জিরোবার।
তরুণ চলেছে হেঁটে পাথুরে রাস্তায়, যেতে যেতে
দেখছে দু’পাশে কত বাড়ি একরোখা তীক্ষ্ণ সাঁড়াশির মতো
নখের হামলা সয়ে দিব্যি টিকে আছে
প্রতিবাদহীন, রক্তধারা বয় দেয়ালে দেয়ালে।এই কি আমার জন্মশহর?-যুবক ভাবে এবং চালায়
পদযুগ অযান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ভেতরের সব
ক্ষয়ে-যাওয়া যন্ত্রের আসর কেঁপে ওঠে ভয়ানক,
তরুণ সতেজ হাওয়া টেনে নিতে চায়, নিতে থাকেসোজা বাঁকা নানা পথে চলতে চলতে
যুবকটি দ্যাখে কোনও দিকে সবুজের চিহ্ন নেই,
ইতস্তত একটি কি দুটি গাছ মরে পড়ে আছে;
একটি পাখিও চোখে পড়েনি সন্ধানী তরুণের।
কী করবে? কোন্ দিকে যাবে আর? সিদ্ধান্ত গ্রহণে
ব্যর্থ সে তরুণ; অকস্মাৎ কে যেন প্রবল টানে
পেছনে ঠেলছে তাকে, অসহায় যুবা জংধরা
খাঁচার ভেতর দ্রুত ফিরে যেতে থাকে।হায়, প্রত্যাবর্তনের পরেও কেমন ব্য্যাকুলতা জন্ম নেয়
জংধরা খাঁচার ভেতর, তরুণের ঘাড়ে নেমে-আসা স্ফীত
কেশরাশি ফুঁসে ওঠে ঘন ঘন, ঘুমন্ত যৌবন
অধীর বাড়ায় হাত অনুপম জাগৃতির দিকে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | এই তো দাঁড়ানো তুমি সম্মুখে আবার একাকিনী
চোখে নিয়ে শতাব্দীর অস্তরাগ। মনে হয়, সাত
সুমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে এসেছো, রিনিঝিনি
রক্ত বাজে আমার শিরায়। জ্যোৎস্নাময় মধ্যরাত
তোমার শরীর, স্মিত ত্বকে বাংলাদেশের গ্রীষ্মের
মোহন দহন প্রাথমিক এবং তোমার ঠোঁটযেন তরমুজ-ফালি তৃষ্ণার্তের কাছে। এ দৃশ্যের
বর্ণনা কী করে দিই? পারতেন নক্ষত্রের কোট-
পরা কোনো চিত্রকর ভালোবেসে আঁকতে তোমাকে,
পারতেন সহজেই ফর্ম ভেঙে পিকাসো মার্তিস
নব্য কোনো ফর্মে অমরতা দিতে তোমার সত্তাকে।
গোপনে তোমাকে দেখে দেবতাও দেয় দীর্ঘ শিস।আমার স্বপ্নের অন্তরঙ্গ সবুজ উপত্যকায়
তোমার যৌবন শত নীলকণ্ঠী পাখি সৃষ্টি করে,
যে-যৌবন গুণীর তানের মতো ঢেউ দিয়ে যায়
নিসর্গের জায়মান আনাচে কানাচে। বায়ুস্তরে
বিদ্যুল্লতা, জ্বলজ্বলে নগ্নতাকে ঢাকবার ছলে
রাখো হাত যোনিতে এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদেরঘ্রাণ জেগে থাকে বাহমূলে, দুটি শ্বেতপদ্ম জ্বলে
বুকে নির্নিমেষ, বুঝি তুমি হাতের মুঠোয় ফের
রহস্য রেখেছো পুরে, আমার গহন অন্তস্তলে
শামুক, পাথর, শঙ্খ এবং সোনালি মাছ মাতে
বন্দনায় তোমার নিদ্রিত নগ্নতার ছায়াবীথি
গড়ে ওঠে তোমার আমার মধ্যে ঢেউয়ের আঘাতে।এমন নীরব তুমি, যেন কোনো ভাষা জানা নেই
এখনো তোমার, শুধু এক সুর উভিন্ন সত্তার
বাঁকে বাঁকে বয়ে যায়। হে আমার নতুন অতিথি,
ফেনা থেকে উঠে-আসা, আমার হৃদয় তোমাতেই
নিজস্ব আশ্রয় খোঁজে। জলবিন্দুময় স্তনভার
আমার চৈতন্যে আনে হৃত স্বর্গের বর্ণিল স্মৃতি! (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ইদানীং তুমি বড় বেশি ঔদাস্যের কথা বলো,
বড় বেশি তুমি খেলে যাচ্ছো ধুধু নির্লিপ্তির হাতে-
যেন সূর্যরাজা তার অন্ধকার রাণীকে সপ্রাণ
করে না চুম্বন আর, যেন দূর স্বপ্নের গাংচিল
এখন তোমার চারপাশে ওড়াউড়ি ভুলে গেছে,
কোনো ফুলে ঘ্রাণ নেই, সবচে সুস্বাদু ফলও খুব
স্বাদহীন, এ রকম তোমার ধরন ইদানীং।যখন তোমার কণ্ঠস্বরে ঔদাস্যের ছায়া পড়ে,
হু হু রুক্ষ প্রান্তরের দৃশ্যহীন দৃশ্যাবলী জাগে,
অকস্মাৎ করোটির ভেতরে আমার চকচকে
রেজরের মতো কিছু ভীষণ ঝিকিয়ে ওঠে আর
স্বপ্নময় তারপুঞ্জ ছিন্নভিন্ন হয়। করোটিতে
শত শত নামহীন কবরের ফলক এবং
রাশি রাশি উন্মুখর ফুল, প্যাগোডার স্বর্ণচূড়ো,তিনটি বিবর্ণ তাস, পলায়নপর অশ্বপাল,
ব্রোঞ্জস্থিত পরস্পর নানা স্বপ্ন বিনিময়কারী
যমজ বিযার ক্যান প্রতিবেশী। ঔদাস্য তোমার
তোমাকে বসিয়ে রাখে ভুল প্রত্যাশার পথপ্রান্তে,
স্বপ্ন-বিবর্জিত হাহাকারময় বিজন সৈকতে।
তোমার ঔদাস্য-মরু উজিয়ে সকাল দশটায়
অথবা বিকেল পাঁচটায় কিংবা কোনো সন্ধ্যেবেলা
যখনই তোমার কাছে যাবো বলে দর্পণে তাকাই
শার্টের কলার ঠিক করে নিই, আড়চোখে দেখি
শাদাকালো চুল, শিরাপুঞ্জে বেজে ওঠে কনসার্ট,
কোন্ ইন্দ্রজালে এ আমার আটচল্লিশের মুখ
আটাশের মুখ হয়ে যায়? সুদূর সুন্দরবন,
চাটগাঁর কুঁজোপিঠ কাজল পাহাড়, সমুদ্রের
ঢেউমালা সিলেটের টিলাস্থিত কোনো স্মৃতিময়
প্রাচীন দুর্গের মতো বাড়ি, মন্টি-মন্টি প্রতিধ্বনি
পরিপূর্ণ ঝিল, গাছপালা আর ঢাকার আকাশ
ছাপিয়ে তোমারই মুখ উদ্ভাসিত আমার দৃষ্টিতে।যখন পাইনা দেখা, আমার নিকট থেকে তুমি
যখন অনেক দূরে, তোমাকেই দেখি তন্বী গাছে,
ফুলের আভায়, শস্যক্ষেতে, হরিণের মতো এই
থমকে দাঁড়ানো গলিপথে আর আমার আপন
করতলে, পাঁজরের মরুভূমি, চোখের সৈকতে।
আমার এখনকার প্রতিটি কবিতা তার বুক
উন্মোচন করে বলে,-এই তো এখানে তুমি আছো।
তুমিহীনতায় প্রতিদিন আমার কবিতাবলী
তুমিময় হয়, সেখানেই রোজ খুঁজবো তোমাকে,
দেখবো দু’চোখ ভরে বহুবর্ণ বাক্যের ওপারে।
কি উপমা কি উৎপ্রেক্ষা অথবা প্রতীক ইত্যাদির
পরপারে তুমি আছো হৃদয়ের পরগণা জুড়ে।যতদিন বেঁচে আছি, থাকবে আমার কাছে তুমি
চিরকাল হৃৎস্পন্দনের মতো, অবিচ্ছিন্ন কোনোযন্ত্রণার মতো সর্বক্ষণ। আপাতত ঔদাস্যের
বিজন গেরুয়া প্রান্তে দাঁড়িয়ে একাকী ছায়াময়
তোমার ভবিষ্যতের দিকে মুখ রেখে এ হৃদয়
কেবলি ডাকতে থাকে আর্ত এক পাখির মতোন। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | নিদ্রার জরায় ছিঁড়ে বেরোয় স্বপ্ন
কানকো উন্টিয়ে মাছ পরখ করার মতো
স্বপ্নের বিশ্লেষণে মনোযোগী হই
অস্পষ্টস্মৃত ভগ্মংগুলো পিছলে যায় মাছেরই ধরনে
তারা- ঝোপের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে বেড়াল
রাত্রি আর বেড়ালের এমন ফষ্টিনষ্টি কখনো দেখিনি
অবশ্য স্বপ্নজীবী
জাগরণের পরেও মাথা ফাঁকা দেখলে
সিঁধেল চোর স্বপ্ন আবার ঢুকে পড়ে হঠাৎ
চোখের পশ্চাদ্দেশে হাত বুলোয় নাক ঘষে
তখন বিশ্ব এবং আমার পরিচয়ের উপর
যবনিকা পতন
বালিশ চুমো খায় মাথাকে
মাথা হাওয়াকে আর হাওয়া আমার চুল
চোখ কান নাক পাঁজর নখ
বুকের রোমরাজি আর নিদ্রাতুর শিশ্নকে
শিশ্ন স্বপ্নের ছ্যাঁদায় সুড়সুড়ি দেয়
এবং স্বপ্ন এখন রজস্বলা (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ভোরের গোলাপ দ্যাখো মেলেছে কী পূর্ণ দৃষ্টি তাজা,
টেবিলে রোদের গাথা, হলতে পর্দা দোলে মাত্রাবৃত্তে;
উড়িয়ে-আঁচল, ঢেউ তুলে বায়ুস্তরে একাকিনী
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বাগানে পাখির ঝাঁকে, পাতায়-পাতায় আনন্দের
গুঞ্জরণ, আলনায় শার্ট আর পাজামায় জাগে
শিহরণ অব্যক্ত স্বপ্নের মতো। সুগন্ধি নিঃশ্বাস নিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
পুরোনো কবরে সাদা কবুতর ঝরিয়ে পালক
উড়ে যায় আসমানে, গোর-খোদকের শক্ত হাতে
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে গন্ধরাজ, মাধুর্যে সুস্মিতা,
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
এই তো ডালিম গাছে কত যে স্বপ্নিল টেলিগ্রাম,
টেলিফোন যেন মেঘচর পাখি বিমুগ্ধ উড্ডীন,
তোমার চন্দ্রালোকিত কণ্ঠস্বর হওয়ায় ঝরিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বৃষ্টিতে পাখির কান্না, আমার হাতের নখ থেকে
ভুরু থেকে, ওষ্ঠতট থেকে নিঃসঙ্গতার মতন
বৃষ্টি ঝরে অবিরল, কালো বৃষ্টি-জাল ছিন্ন করে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
যে-দরজা নেই তা খোলার জন্যে একটি সোনালি
চাবি পেয়ে গেছি গোধূলিতে, একজন আলুথালু
কিশোর সারস হাতে রয়েছে দাঁড়িয়ে-সেই পথে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
রেশমি পতাকা হয়ে ওড়ে খবর কাগজ আর
কফির বাতিল কৌটো, পিলসুজ স্বপ্নে ভরপুর;
কবি শব্দহীনতার ছায়ায় ঘুমোয়, বাণী হয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার? (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও;
নির্দয় স্মৃতি মিতালী পাতায় শত করোটির সাথে।
নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।সে কবে আমিও স্বপ্নের বনে তুলেছি গোলাপ,
শুনেছি কত যে প্রহরে প্রহরে বনদোয়েলের ডাক।
অবুঝ সে মেয়ে ক্রাইসোথেমিস্ আমার সঙ্গে
মেতেছে খেলায়, কখনো আমার বেণীতে দিয়েছে টানে।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।পিতৃভবনে শুনেছি অনেক চারণ্যের গাথা,
লায়ারের তারে হৃদয় বেজেছে সুদূর মদির সুরে।
একদা এখানে কত বিদূষক প্রসাদ কুড়িয়ে
হয়েছে ধন্য, প্রধান কক্ষ ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।প্রজাপতি-খুশি ফেরারী এখন, বিষাদ আমাকে
করেছে দখল; কেমন বিরূপ কুয়াশা রেখেছে ঘিরে।
রক্তের ডাকে দিশেহারা আমি ঘুরি এলোমেলো,
আমার রাতের শয্যায় সুধুক কান্নার স্বাক্ষর।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
সেইদিন আজো জ্বলজ্বলে স্মৃতি, যেদিন মহান
বিজয়ী সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।
শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উল্লাস;
পথে-প্রান্তরে তাঁরই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে
গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধ্বসে।
বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,
নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।নিহন জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।আড়ালে বিলাপ করি একা-একা, ক্ষতার্ত পিতা
তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।
এমন কি, হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি
নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
মাথার ভেতরে ঝোড়ো মেঘ ওড়ে, আমি একাকিনী
পিতৃভবনে আমার কেবলি সোক পালনের পালা।
পিতৃহন্তা চারপাশে ঘোরে, গুপ্তচরের
চোখ সেঁটে থাকে আমার ওপর, আমি নিরুপায় ঘুরি।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।কখনো কখনো মাঝরাতে আমি জেগে উঠে শুনি
পায়ের শব্দ, আস্তাবলের ঘোড়ার আর্তনাদ।
শিকারী কুকুর ঘরের কপাট ঠ্যালে অবিরত,
আমার রক্তে দাঁত-নখ তার সিক্ত করতে চায়।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ভোরে
মেলবো দু’চোখ, দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
যতদিন পাবো বাতাসের চুমো, দেখবো তরুণ
হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করবো শোক।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
অন্ধের দেশে কে দেবে অভয়? ভাই পরবাসে;
যে নেবে আমার মহা দায়ভাগ, তেমন জীবনসঙ্গী কই?
কেমন ছাদের নিচে সহোদর ছেঁড়ে তার রুটি?
কোন্ প্রান্তরে ওড়াচ্ছে ধূলি ওরেস্টেসের ঘোড়া?নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
কান পেতে থাকি দীপ্র কণ্ঠ শোনার আশায়,
কাকের বাসায় ঈগলের গান কখনো যায় কি শোনা?
ক্রাইসোথেমিস, অবুঝ তন্বী, দূরে সরে থাকে,
বিকচোন্মুখ শরীরে এখন লায়ারের ঝংকার।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।আমার উপমা দাবানলে-পোড়া আর্ত হরিণী;
মৃতের মিছিল খুঁজি দিনরাত, আঁধারে লুকাই মুখ।
করতলে কত গোলাপ শুকায়, ঝরে জুঁই, বেলী;
আমার হৃদয়ে প্রতিশোধ জ্বলে রক্তজবার মতো।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।পারবো না আমি হানতে কখনো ক্রুর তরবারি,
যদিও ক্ষুব্ধ হৃদয় আমার, প্রতিশোধ জপমালা।
আত্মশুদ্ধি ঘাট যায় যদি দেখি সন্ধ্যায়
উড়ন্ত দু’টি সারস কী সুখে নদীটি পেরিয়ে যায়।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।যে যেমন খুশি যখন তখন বাজাবে আমাকে
নানা ঘটনায় ষড়জে নিখাদে, আমি কি তেমন বাঁশি?
কন্টকময় রক্ত পিপাসু পথে হাঁটি একা;
আমার গ্রীবায় এবং কণ্ঠে আগামীর নিশ্বাস।নিহত জনক, ত্র্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ। |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কত যে খণ্ডিত হই রোজ
নিজেই জানি না।
পথে যেতে যেতে কত অচেনা মুখের
সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু কথা না ব’লেই
যে যার গন্তব্য চলে যাই। এই মতো
আচরণ নিন্দনীয় নয় ব’লে বিবেচিত মানব সমাজে।পক্ষী সমাজের কিছু আচরণ ভিন্ন,
জানা আছে। ওরা
বস্তুত একলা নয়, দল বেঁধে চলে,
একত্রে আহার করে অবসর উপভোগ করে
মিলে মিশে এক জায়গায়। নিজেদের
মধ্যে মানুষের মতো খুনোখুনি করে না কখনও। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এই পৃথিবীতে দেখতে দেখতে
অনেক কিছুরই রঙ বদলায়,
এই চিরচেনা আকাশের রঙ-
তা-ও চদলায় অবেলায়।
কখনো কখনো মেঘ হয়ে যায়
গ্রাম্য মেলার ঢ্যাঙা এক সঙ,
কখনো সে মেঘ এক লহমায়
সুরসুন্দরী, কখনো ঝিনুক,
বুদ্ধ রাজার বিষণ্ন মুখ।
কোনো কোনো ফুল রঙ পাল্টায়,
কোনো কোনো প্রাণী পারে আগাগোড়া
বদলাতে রঙ। শুধু ডোরাকাটা
বাঘ পারেনাতো পাল্টাতে, হায়,
তার বিখ্যাত জ্বলজ্বলে ডোরা। |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | পথে বেরুলেই পড়ে চোখে। সকাল দুপুর কিংবা
বিকেলের খরচা-হ’য়ে-যাওয়া রোদে অত্যন্ত গোচরে
আসে ওরা, যেমন দোকানপাট, রাস্তার কুকুর,
রঙিন সাইনবোর্ড, কৃষ্ণচূড়া, গম্বুজের পায়রা অথবা
ট্রফিক পুলিশ। বুকজোড়া দাবিদাওয়ার নানা
উল্কি নিয়ে ওরা স্পষ্ট উপস্থিত দেয়ালে দেয়ালে,
প্রগলভ্ পোস্টার, বারো মাস তেরো পার্বণের সাজ
এই শহরের; রৌদ্রে জলে চেয়ে থাকে অপলক।এবং চলতি পথে বেকার যুবক বাসযাত্রী কেউ কেউ,
ক্লান্ত কবি, মেজো সেজো কর্মচারী নানা দপ্তরের,
সিমেমাগামিনী তন্বী, ফেরিঅলা, দুস্থ বুড়োসুড়ো
লোক, ভিড়ভাট্রা অপছন্দ যার- সবাই পাঠক
দারুণ মুখর সব পোস্টোরের। অলজ্যান্ত কিছু
অক্ষর নক্ষত্র হ’য়ে ভাসে তাদের নিজস্ব নীলিমায়।আমারও বিষম ইচ্ছে, সমস্ত শহরে দেবো সেঁটে
একটি পোস্টার গরীয়ান, শুধু করবো সে লৌকিক
ভাষার কিছুটা হেরফের- আমার একান্ত দাবি,
চাই, তাকে চাই, শুধু তাকে উৎসবে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র-
বিপ্লবে তাকেই চাই সর্বদাই। আমার পোস্টার
মেলবে সুস্নিগ্ধ চোখ, হ’য়ে যাবে নবীন মাথুর। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | আদ্যিকালের বেবাক কিছুই অলৌকিক।
পক্ষীরাজের পক্ষছায়ায় দিগ্ধিদিক
নীল আকাশে উড়ত কত রাজকুমার।
আদ্যিকালের আজব কথার নেই শুমার!ফলত সদা সোনার ডালে হীরের ফল,
জাগত জ্বেলে ঘিরের প্রদীপ লালকমল,
অসির খেলায় দৈত্যদানো করত বধ।
মরুভূমি, দূরের পাহাড়, মায়ার হ্রদ
উড়ন্ত সেই গালিচাটায় হচ্ছে পার।
সাত সফরে এই জীবনের সত্যসার
সিন্দাবাদের নখমুকুরে বিম্বিত।
সোনার কাঠি রুপোর কাঠি চিহ্নিত
ঘুমের খাটে শঙ্খমালা ঘুমন্ত;
কৌটো খোলা ভোমরা মরে জীবন্ত।ঐরাবতের খেয়ালখুশির ধন্দায়
ভোরের ফকির মুকুট পরে সন্ধ্যায়।
প্রাক্তন সেই ভেল্কিবাজির মন্তরে
যাচ্ছে চেনা অনেক সাধু-সন্তরে।সেই চালে ভাই মিত্র কিবা শত্তুর
চলছে সবই-মস্ত সহায় হাতির শুঁড়! (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার কবিতা নিয়ে রটনাকারীরা আশেপাশে
নানা গালগল্প করে। কেউ বলে আমার কাব্যের
গোপনাঙ্গে কতিপয় বেঢপ জড়ুল জাগরুক,
ওঠেনি আক্কেল দাঁত আজো তার, বলে কেউ কেউ।আমার কবিতা নাকি বাউন্ডুলে বড়ো, ফুটপাথে
ঘোরে একা একা কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে ব’সে থাকে,
ইন্দ্রিয়বিলাসে মজে বন্ধ কুঠুরিতে, মাঝে-মাঝে
শিস দেয়; আমার কবিতা খুব বেহুদা শহুরে!একরত্তি কান্ডজ্ঞান নেই তার, সবার অমতে
সোৎসাহে চাপিয়ে গায়ে আজব জ্যাকেট, কেয়াবাং,
সুনীল লন্ঠন হাতে দিনদুপুরেই পর্যটক
এবং অভ্যাসবশে ঢোকে সান্ধ্য মদের আড্ডায়।মদের বোতল রুক্ষ গালে চেপে অথবা সরোদে
চুমু খেয়ে অস্তিত্বহীনতা বিষয়ক গান গায়,
এবং মগজে তার নিষিদ্ধ কথার ঝাঁক ওড়ে
মধুমক্ষিকার মতো সকালে কি রাত বারোটায়।আমার কবিতা অকস্মাৎ হাজার মশাল জ্বেলে
নিজেই নিজের ঘর ভীষণ পুড়িয়ে দেখে নেয়
অগ্নুৎসব; কপোতীর চোখে শোক; এদিকে নিমেষে
উদ্বাস্তু গৃহ দেবতা, কোথাও করবে যাত্রা ফের।
বিদ্যের জাহাজ দ্রুত চৌদিকে রটিয়ে দেয়, ‘ওর
পদ্যটদ্য এমনকি ইকেবানা নয়, এইসব
আত্মছলনার অতি ঠুনকো পুতুল-টিঁকবে না,
ভীষণ গুঁড়িয়ে যাবে কালের কুড়ুলে শেষমেষ।
যখন পাড়ায় লাগে হঠাৎ আগুন ভয়াবহ,
আমার কবিতা নাকি ঘুমোয় তখনও অবিকল
গাছের গুঁড়িয়ে মতো ভাবলেশহীন। আর ঘুম
ভাঙলেও আত্মমগ্ন বেহালায় দ্রুত টানে ছড়!আমার কবিতা করে বসবাস বস্তিও শ্মশানে,
চাঁড়ালের পাতে খায় সূর্যাস্তের রঙলাগা ভাত,
কখনো পাপিষ্ঠ কোনো মুমূর্ষ রোগীকে কাঁধে বয়ে
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় আরোগ্যশালায়।আমার কবিতা পথপ্রান্তে দুঃখীর চোখের মতো
চোখ মেলে চেয়ে থাকে কার পায়ের ছাপের দিকে,
গা ধোয় ঝরনার জলে। স্বপ্ন দ্যাখে, বনদেবী তার
ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে হু হু জ্বলছেন সঙ্গম-লিপ্সায়! (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | গভীর নিশীথে যখন বাড়ির সবাই ঘুমের
চুমোয় অচিন বাগানে মুগ্ধ, আমি জাগ্রত
একাকী লেখার টেবিলে কলম হাতে নিয়ে আর
দূরের আকাশে তারাগুলো হাসে কবির কাণ্ডে।
এই যে নিজেকে কবি বলে মেনে নিয়েছি কিছুটা-
ব্যাপারটি ঠিক হয়নি শোভন। মাঝে মাঝে ভাবি,
সত্যি কি আমি পেরেছি দাঁড়াতে এখনও প্রকৃত
সৃজন-মুখর কবির সারিতে? কে দেবে ভরসা?ভীষণ আঁধার আমাকে চকিতে মুছে ফেলে দিলে,
আমার সৃষ্টি শব্দমালা কি ঝুলবে তখনও
পাঠক-সমাজে? জানবো না, হায়, কিছুতেই আর।
তবুও সফেদ কাগজ সাজাই কালো অক্ষরে।হয়তো আড়ালে জাঁদরেল কোনও ক্রিটিক অধরে
বাঁকা হাসি টেনে আমার বেচারা কবিতার বই
ছুড়ে ফেলে দেন বাজে কাগজের ঘৃণ্য পাহাড়ে।
এই পরিণতি জেনেও এখনও বেহায়া মাথায়
এক রাশ শাদা কাশফুল নিয়ে কখনও সকালে
দুপুরে অথবা গভীর নিশীথে কলম চালাই। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | অপার প্রসন্নতায় ছিলেন তিনি ঘর-দুয়ার
আগলে; নোংরা গলিতে,
রাস্তায় রাস্তায় বাজতো
তাঁর জুতোর আওয়াজ বাদ্যযন্ত্রের মতো। কখনো
দেখা যেত, হেঁটে চলেছেন
তিনি প্রান্তরের নীল প্রান্ত ঘেঁষে,পেরুচ্ছেন সাঁকো,
শস্যক্ষেতের ফসল ছাপিয়ে
জেগে উঠছে হরফ আলিফ-এর মতো তাঁর
ঋজু আর অনন্য শরীর। বনরাজিনীলার রহস্যময়তা
আর ডাগর নদীর ছলাৎছল শব্দ
কণ্ঠে ধারণ ক’রে তিনি সকলের জন্যে গাইতেন
ঘর ছাড়ার কীর্তন, ঘরে ফেরার গোধূলিপ্রতিম পদাবলীতাঁর সুরে বিষ-কাটালির ঝোপঝাড়
রূপান্তরিত হতো রজনীগন্ধাবনে, গুচ্ছ-গুচ্ছ পলাশে
চেয়ে যেত মেঘের পাড়,
নদী হতো অজস্র নারীর কলস্বর,
পাহাড় মস্তিতে ভরপুর দরবেশ। সে-গানে
আকাশ পরতো সূর্যের মুকুট।
সেই গীতধারায়
স্নাত গাছপালা পেতো স্বর্গীয় সৌন্দর্য।
অলংকারহীন সে-গান পান্থশালায়,
গেরস্তের কুটিরে, কারখানার চত্বরে চত্বরে,
খনির সুড়ঙ্গে, হাসপাতালের করিডোরে, ঝর্ণার ধারে
উড়ে-আসা পাতায়,
বেকারের বিবরে কী ব্যাপক
ছড়িয়ে পড়তো যেন স্মৃতিমুখর তেজালো জোয়ার।যত অন্তরারেই থাকুন তিনি, সে-গান
ঘোষণা করে তাঁর উপস্থিতি। ঘোর অমাবস্যায়
তাঁর হাতের মুঠোর থেকে ছল্কে পড়ে জ্যোৎস্না,
চোখ থেকে ঝরে ফুলের রেণু,
জামার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে
রঙ-বেরঙের পাখির ঝাঁক। তিনি যখানেই যান,
তাঁর সঙ্গে যায় লোক, রাস্তা-উপচে-পড়া লোক,
যেন তিনি এক মোহন ঐন্দ্রজালিক,
যার ইঙ্গিতে মাটিতে মুখ-থুবড়ে-পড়ে-থাকা শহর
নিমেষে তোলে মাথা,
মৌরসীপাট্রার ভুয়া দলিল দস্তাবেজ পুড়ে যায়
এবং বেজায় ছত্রভঙ্গ আততায়ীর দল।প্রহরে প্রহরে ওদের বেয়নেট শাসালো তাঁকে, ওর
ভেবেছিল এতেই নড়বে টনক,
কিন্তু যাঁর ভিতরে গুঞ্জরিত কবিতার ঝলক, তিনি কেন
মাতা নত করবেন পিস্তল আর বন্দুকের নলের অভিযোগের
সামনে? কেন তিনি নিজের স্বপ্নমালাকে
দলিত হতে দেবেন উন্মত্ত হাতির পারের পায়ের তলায়?আখেরে তাঁর, সেই কবির, ঠাঁই হলো আকাশ-ছোঁয়া
দেয়াল-ঘেরা কয়েদখানায়। দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস যায়, অর্ধাহারে,
একাতিত্বের দংশনে গুকায় তাঁর শরীর, হাড়ে ধরে ঘুণ,
অথচ তাঁর আত্মায়
বিরতিহীন দেয়ালি, মৌন উৎসবের নহবৎ।ওরা ভেবেছিল, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ
করলেই, তাঁর পিঠে চাবুকের চেঁচিয়ে-ওঠা ছোবলে
কালসিটে পড়লেই রুদ্ধ হবে
দূরন্ত এক কাহিনীর গতি, কিন্তু তাঁর কবিতাবলিকে
ওরা হাতকড়া পরাতে পারেনি কিংবা বেড়ি। পৃথিবীর
কোনো কয়েদখানারই সাধ্য নেই
তাঁর ঈগলের মতো কবিতাকে
আটকে রাখতে পারে, ডানা তার ঝলসায় আকাশে আকাশে।উত্যক্ত হয়ে ওরা একদিন কবিকণ্ঠে
পরালো মৃত্যুর ফাঁস; আর কী আশ্চর্য, ফাঁসির মঞ্চে
ঝুলন্ত কবির শরীরর প্রতিটি রোমকূপ থেকে বিচ্ছূরিত হলো
কবিতার পর কবিতা, যেন মেঘকৃষ্ণ গর্জনশীল আসমানে
বিদ্যুচ্চমক এবং সেই কবিতাবলি কালদীর্ণ কোকিলের মতো ডেকে
ডেকে
ভীষণ রক্তিম ক’রে তুললো নিজেদের চোখগুলো। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | দেখতে দেখতে ফ্ল্যাটে, গাছগাছালিতে খোলা মনের ভেতরে
হেমন্ত দিনের ছায়া, যাবার সময় হয়ে এল।
সে কখন থেকে তাড়া দিচ্ছে, অথচ এখনো
সুটকেস গোছানো হয়নি।
হ্যান্ডব্যাগ খালি পড়ে আছে। তাড়াহুড়ো
ক’রে খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্তর
হ্যান্ডব্যাগে পুরে দিতে গিয়ে
রাজ্যের ঝামেলা।
বাদামি ফ্লাস্কটা কই? পুতুলেরা মেঝেতে গড়ায়।বড় ঘরে একা, বৃষ্টি ভেজা গন্ধ, কার দীর্ঘশ্বাস
ঘাড় ছুঁয়ে যায়?
তড়িঘড়ি সুটকেসে শার্ট, ট্রাউজার, পাণ্ডুলিপি
ইত্যাদি ভরার পরে সুটকেস কিছুতেই বন্ধ
করতে পারি না আর সবচেয়ে মুশ্কিলে
পড়েছি পুতুল নিয়ে। কাকে ছেড়ে কাকে নেব? তাছাড়া হঠাৎ
জুতো জোড়া কী করে যে এরকম ছোট হয়ে গেল,অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে আছি
সমাপ্তি ঈষৎ উঁকি দিয়ে যায় কৌতূহলে ধুলো ওড়ে।
‘তোমাকে যেতেই হবে? কণ্ঠস্বর শুনে
পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি তরুণী
বড় বড় চোখ মেলে দেখছে আমাকে।
মনে পড়ে, কতকাল দেখিনি তন্বীকে, লাল টিপ
স্মৃতির মতোই জ্বলে, সমগ্র সত্তায় তার মেঘমেদুরতা।
বাঁধা-ছাঁদা কী নিপুণ সেরে
ময়ূরপঙ্খীর মতো সে এগিয়ে এসে বলে-‘কত তুচ্ছ কাজে
বেলা গেল, অথচ কিছুই বলা হলো না আমার।
আমারও কি বলবার মতো ছিল কোনো কথা? চুলে
চিরুনি চালিয়ে ছুটি, সময় তো বেশি বাকি নেই। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | এখনো সে নীলিমায়, একটি সোনালি পাখি খুব
উঁচুতে এখনো
গড়ছে নানান বৃত্ত, কান্তি তার অম্লান, অথচ
মোহন ডানায় তার কিছু ক্লান্তি তুষারের মতো
জমছে নিয়ত, মৃত্যুভয় অমাবস্যা হয়ে তাকে
তুমুল ফেলবে ঢেকে, মনে হয়। কখন সে মুখ
থুবড়ে পড়বে রুক্ষ ধূলায়, নিঃস্পন্দ হবে, তারই
প্রতীক্ষায় আছে অনেকেই
সেই কবে থেকে।‘হবে না উড়তে আর নীলিমায়’, বলে কেউ কেউ,
কেউ ফের দোকানের দড়ির আগুন থেকে শস্তা
সিগারেট ধরাতে ধরাতে
স্বগতে ভাষণে মাতে-উজ্জ্বল ডানায় ওর মৃত্যু
চুমু খাচ্ছে ক্রমাগত; খাক, পড়ুক সে রাজপথে
অথবা গলির মোড়ে, কাকপক্ষী ওকে ঠুকরে ঠুকরে
করুক নাকাল।
প্রায় সকলেই
উড়ন্ত সোনালি পাখিটাকে দূরে নীলিমার থেকে
তাড়াতাড়ি পেড়ে ফেলে মোচ্ছবে ভাসতে চায় গহন দুপুরে।আহত সোনালি পাখি মাটির ঢেলার মতো দ্রুত
পড়ে না ধূলায়। উড়ে যায় বহুদূরে মেঘের ভেতরে একা
কী তেজস্বী ভঙ্গিমায়, যেন অভিষেক হবে তার
অনেক উঁচুতে ঐ নীলিমার রাজ্যে।
কৌতুহলী লোকদল মুখ
অন্ধকার করে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে হতাশায়।
শুধু একজন পোড়খাওয়া অপমানিত মানুষ
সোনালি পাখিকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সটান
হেঁটে যায়, মনে হয় তার
নিজের বেঢপ মাথা পৌঁছে, গেছে নীলিমায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার তিনটি শার্ট চাই আপাতত, এক জোড়া
ট্রাউজার, দুটি গেঞ্জি আর তিন জোড়া জুতো।
আন্ডারওয়ার অবশ্যই, রবিন পাখির মতো কয়েকটি
রুমালও জরুরি। চাই কিছু গ্রন্থাবলি; চাই, চাই-
বীমার কিস্তির টাকা, চাই মাগ্যিভাতা, রেস্ত রোজ।
শুধু কি এসবই চাই? অন্য কিছু নয়?খবর কাগজ ওড়ে হাওয়ায়, যেন ওরা
পরীর পোশাক মিহি ঝলমলে, কিঞ্চিৎ রহস্যময় বটে,
বহুরূপী মেঘের নানান স্তরে ভাসমান দেখি।
সেলুনে মুণ্ডিত হতে দেখি রোজ
কিছু মাথা, রকমারি ছাঁট কী বাহারি চুলে
দেখি মঞ্চে বিদূষক নায়কের কানে
কী যেন কী বলতে গিয়ে হেসে লুটোপুটি,
দুটি শালিখের দিকে একজন বুড়োসুড়ো লোক
ছুঁড়ে দেন বাসি রুটি, গলির ধুলোয়
বালক বানায় দূর্গ, জুয়াড়ী পয়সা গোঁজে ট্যাঁকে।
শুধু কি এসবই দেখি? অন্য কিছু নয়?কখনো গলির মোড়ে অস্পষ্ট সংলাপ শুনি দু’টি
মানুষের, কখনোবা কর্কশ বচসা, চৌরাস্তায়
পুলিশের বাঁশি বাজে, মধ্যরাতে ক্ষিপ্র কুকুরের
পদশব্দ; ফেরি-অলা ডেকে যায় মধ্যবিত্ত কিশোরীকে আর
মহিলাকে সচকিত ক’রে; প্রায়শই গৃহিনীর
অসুস্থ বিলাপ শুনি, রেডিওতে শস্তা গান বাজে
একটানা, অকস্মাৎ মেঘের গর্জন শুনি চৈত্রের আকাশে।
শুধু কি এসবই শুনি? অন্য কিছু নয়? (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | এই যে ইয়ার খানিক দাঁড়াও। এমন হনহনিয়ে
কোথায় যাচ্ছ? এত তাড়া
কিসের মানিক? আখেরে কথায় পৌঁছতে চাও?
এতকাল পরে
এ-শহরে হঠাৎ তোমার সঙ্গে মোলাকাত;
দু-দণ্ড বাতচিত করা যাক কোথাও আরামসে ব’সে
যৎকিঞ্চিৎ ভেজানো যাক গলা। নাকি
এভাবেই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
কিস্সা খতম করে দেবে, ভেবেছ।চলো না যাই, চা খাই ব’সে আমাদের সেই
চেনা চা-খানায়! বিলকুল আগের মতোই আছে বেবাক;
শুধু চেয়ার আর টুলগুলো আরও নড়বড়ে
হয়েছে, টেবিলগুলো রোঁয়া-ওঠা
কুকুরের মতো আরও বয়স্ক। সেই কোঁকড়া-চুল
বেয়ারাটা-মনে পড়ে ওর কথা-গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে
তিন বছর আগে। আজ থেকে-থেকে কত স্মৃতিই না জাগে
তোমার দিকে তাকিয়ে,
তোমার ছাই ঝাড়ার ভঙ্গি দেখে।তো, মাই ডিয়ার ফেলো, আজকাল
কী হাল-হকিকত তোমার, মঞ্চে-টঞ্চে কেমন
বোলচাল দিচ্ছ, বলো। লেখা-টেখার ময়ূরপঙ্খী নাও
বাইছ কোন খালে? এখনও কি হর-হামেশা
পুরোনো নেশায় মজে মেতে হুজুগে
তেমন মালই চালাচ্ছ যা চার যুগ আগেই
বস্তাপচা বলে বাতিল করেছে ইউরোপ। দাদাবাদের ভূত
আজও কি নামেনি ঘাড় থেকে?
উড়ো কথা কানে আসে, তুমি নাকি
কবিতা লেখার ফাঁকে-ফাঁকে সস্তা চিটচিটে
উপন্যাসের ঊর্ণাজালে পাঠক আটকে
কেল্লাফতে করছো। তাহলে কী হিল্লে হবে
আমাদের অহল্যা কাব্যেরসত্যি দোস্ত, তোমার রকম-সকম
ভালো ঠেকছে না। খাতায় খাতায় আদুরে পায়রার
চোস্ত বকবকম বুলি ছিটিয়ে
চালাবে আর কতকাল? একদিন যারা
তোমার এই কানামাছি খেলা হাতে-নাতে ধরে ফেলবে,
তারা বাড়ছে ঘরে-ঘরে। আচ্ছা,
তোমার এত কেমন খেয়াল বলো তো, প্রহরে-প্রহরে
মিথ্যের সাজি ভরে তুলে কী আনন্দ পাও তুমি? বরং
যা কিছু সাচ্চা তার জন্যে
উঠোন নিকিয়ে রাখো, মাধুর্যের রঙ ছড়িয়ে আলপনা আঁকো,
খুলে রাখো দরজা।এবার তোমার ক্রীতদাস লেখনীকে
স্পার্টাকাসের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে, শক্ত, ঠাণ্ডা শেকল ছিঁড়ে
আয়ামে জাহেলিয়াতের দম-বন্ধ করা অন্ধকারে
নতুন কথার স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে বলো। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | যাচ্ছি, ক্রমাগত যাচ্ছি; সেই কবে থেকে
আজ অব্দি, বলো,
কোথায় চলেছি? বলা যায়,
এই অধমের আওতায়
যা-কিছু দেখার আর শোনার, ছোঁয়ার
সবই তো হয়েছে এ জীবনে-
বিনীত স্বীকার করি গোধূলিবেলায়,
তবু কেন মনোলোকে তুষারের স্তূপ?আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে কোনও
বিবাদ, ঝগড়াঝাঁটি নেই,
নেই কোনও বায়বীয় খেদের বালাই। এই মাটি,
হাওয়ার চুমোয় শিহরিত গাছের সবুজ পাতা,
রাঙা ফুল পথরেখা, নদীর রূপালি
নাচ, মোলায়েম মেঘে পাখির সাঁতার,
শিশুর অনিন্দ্য হাসি, নারীর প্রণয়,
তারুণ্যের কণ্ঠে জীবনের, প্রগতির গান আজও ভালবাসি।
অথচ কখনও ভোরবেলা চোখ থেকে
ঘুমের কুয়াশা মুছে গেলে,
অথবা রাত্তিরে কোনও কবিতা লেখার দীপ্র ক্ষণে দয়িতার
মুখশ্রী খাতার বুকে জেগে
ওঠার মুহূর্তে অকস্মাৎ মৃত্যুচিন্তা অতিশয়
কালো লেবাসের অন্তরালে ফিস্ফিস্ স্বরে বলে,-
“আমি আছি, বুঝেছ হে, কোন দিন কখন যে
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটে নেব প্রাণ, জানবে না”।
শোন, এই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, জ্যোৎস্নামায়া
উপভোগ করে বহু জ্ঞানী বলে গেছেন, আখেরে
মরণ তো অবসান, অস্তিত্বের পরিণতি ‘মুঠো
মুঠো ধুলো।‘ এই যে গভীর রাতে জেগে
সাজিয়ে চলেছি পঙ্ক্তিমালা কিংবা অতীতে লিখেছি
কতই না গ্রন্থ, সেগুলো পাহাড়ে,
নাকি হায়, সুবিপুল বিস্ফোরণজনিত কণায়? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চিরচেনা নদীটির তীরে
এসে দেখি জনহীন ঘাট, হা কপাল,
একটিও নৌকা নেই। বুকের ভেতর হু হু হাওয়া
বয়ে যেতে থাকে, ব্যগ্র দৃষ্টি ঢেউদের ব্যাকুলতা করে পাঠ।আমি তো ভেবেছিলাম, রঙিলা নায়ের মাঝি হাত
নেড়ে গলা ছেড়ে ডেকে নেবে
আমাকে নৌকায় তার, আমি হাসি মুখে
যাব সেই দিকে আর বসব বাদামি পাঠাতনে।নদীতীরে নৈঃসঙ্গের হাত ধরে চলে পায়চারি
কিছুক্ষণ, অকস্মাৎ আমার আপনকার মাথার ভেতর
মসৃণ প্রবেশ করি-সে এক বেগানা
আশ্চর্য জগৎ বটে, নানাবিধ পাখি ওড়ে রঙধনুময় ঠিকানায়।বেলা ক্লান্ত হয়ে এলে পর দিগন্তের আবছায়া ভেদ ক’রে
ভেসে ওঠে এক তরী, কে জানে কীসের
টানে ঠিক নদীতীর অভিমুখে খুব দ্রুত চলে
আসে, মাঝি নেই, কেউ নেই, তবু তরী আমন্ত্রণময়!কী এক অপূর্ব ঘোরে উঠে পড়ি তাড়াতাড়ি রঙিলা নায়ের
যাত্রী রূপে। অচমকা কারা যেন বেঁধে ফেলে আমার দু’হাতে,
হো-হো হেসে ওঠে অন্তরালে, অসহায় আমি’ মন-মাঝি তোর
বৈঠা নে রে’ ব’লে সাড়া তুলি নায়ে, গতি পায় নির্জন তরণী। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | মাস্টারদা, আপনি কি হাতঘড়ি পরতেন কখনো,
এই প্রশ্ন আমাকে ঠোকর মেরেছে
অনেকবার মাস্টারদা, আপনার বিষয়ে
অনেক কিছু জানা আছে আমার।
আপনার শরীরের গড়ন, মূল্যবান রত্নের মতো
চোখের দীপ্তি, জীবন-যাপনের
ধরন-একরম
বহুবিধ খুঁটিনাটির আলো আমি পেয়েছি
গ্রন্থের কালো অক্ষরের মধ্যে ভ্রমণ করতে করতে।কিন্তু মাস্টারদা, আপনি কখনো
হাতঘড়ি পরতেন কিনা আজ অব্দি আমার জানা হয়নি।
তবে আপনি যে মাঝে-মধ্যে ঘড়ির দিকে
তাকাতেন, তা ধরে নেয়া যেতে পারে।
যিনি নিজে সময়কে শাসন করেন,
সময়ের শাসনও তাকে মেনে নিতে হয়
কখনো সখনো। যখন আপনি পিস্তলের
ট্রিগার টিপেছেন কিংবা মেতেছেন
গোরা সেনাদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে
অথবা পায়চারি করেছেন চট্রগ্রাম জেলের
নীরন্ধ্র সেলের ভেতর,
তখন সময়ের ধ্বনির প্রতি আপনি কি
উদাসীন ছিলেন?মাস্টারদা, সেই যে মাঝে-মাঝে
আপনার কণ্ঠে উচ্চারিত হতো একগুচ্ছ শব্দ,
সেই অনুসারে আপনি নিজে
চোখেও শুনতেন, কানেও দেখতেন।
ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বীর আশফাকউল্লাহ, অপরূপ
অগ্নিবলয়ের মতো এক মহামাল্যের মণিরত্ন,-
ওদের ঝলকানিতে গান গেয়ে উঠতো
আপনার চেতনা, যখন আপনি বসে থাকতেন
চুপচাপ, নীল নকশা আঁকতেন প্রতিরোধের
কিংবা সহযাত্রীদের উদ্ধুদ্ধ করতেন
সামনে পা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে।মাস্টারদা, যখন আপনার মাথার ওপর
ঝুলছিল ফাঁসির দড়ি, তখন
আপনার ঋজু মেরুদণ্ড কি শিরশিরিয়ে উঠেছিল
শীতার্ত ডালের মতো; আপনার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কি থেমে গিয়েছিল
ক্ষণিকের জন্যে? মাস্টারদা, আপনার
ব্যক্তিগত মৃত্যু এক লহমায়
হয়ে উঠেছিল বিপুল জনগোষ্ঠীর যুগপৎ
মৃত্যু এবং জীবন।
মাস্টারদা আপনি কখনো
হাতঘড়ি পরতেন কিনা জানি না; জানবার
প্রয়োজনও নেই তেমন। অমরতা
জ্যোতির্বলয়ের মতো রাখী পরিয়ে দিয়েছে
আপনার কব্জিতে।
আপনার হাত সূর্যোদয়ের প্রসন্নতা নিয়ে
প্রসারিত হয়ে আছে সেই বিশাল ভূখণ্ডের দিকে,
ভাবীকাল যার ডাকনাম।
এবং একটি অলৌকিক হাতঘড়ি, যা আপনি
হয়তো, পরেননি, অথচ আপনারই নামাঙ্কিত
ক্রমাগত বেজে চলেছে
আমাদের হৃৎপিণ্ডে, অনন্তের রৌদ্র-নিঃসীম ঝালরে। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বুকের কাছে একগুচ্ছ নীল ফুল ফুটল, আমি ওদের
নাম রাখলাম অভিমান। ফুলগুলোর
ভেতরে অকস্মাৎ অজস্র কাঁটা গজিয়ে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
প্রায় উন্মত্ততার খাদের ধারে নিয়ে গেল।
আমি কি বলিনি আমাকে তুমি এভাবে দণ্ড দিও না
কখনো, যা আমার রক্ত শুষে নেয় ড্রাকুলার মতো?
তোমার কথা ভেবে ভেবে আমি আজ প্রতি মুহূর্তে
আতশবাজি হয়ে জ্বলেছি, হয়েছি ফিনিক্স পাখি।তোমাকে ঘিরে আমার স্বপ্নেরা মেতেছে সুফী-নৃত্যে
আমার অন্তরের তন্তুজাল থেকে বেরিয়ে এসেছে শব্দের ঝাঁক,
সেসব শব্দকে তোমার প্রিয়ংবদা সহচরী বানিয়ে
নিজেকে বুভুক্ষু রেখেছি। অথচ তুমি
উদাসীনতায় মজে একটি শব্দও খরচ করলে না
কিছুতেই, এখন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির মতো অনিদ্রায় ভুগছি। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | একবার বাগে পেলে আমাকে মাটিতে ফেলে যারা
আদিম হিংস্রতা নিয়ে খোঁচাবে বল্লমে, নিষ্ঠীবন
ছিটোবে বিস্তর মুখে এবং চুলের মুঠি ধরে
হিড় হিড় টেনে নিয়ে যাবে গোরস্তানে কিংবা হৈ হৈ
নাচবে আমাকে ঘিরে, কী অবাক কাণ্ড, তুমি আজ
তাদেরই শিবিরে মক্ষিরাণী হয়ে আছো সগৌরবে।
দৈবক্রমে দেখা হলো আমাদের বিপন্ন বেলায়,
সবকিছু জেনে শুনে একটি গোলাপ, হৃদয়ের
রক্তসেচে ফুটে-ওঠা, দিলাম তোমার করতলে
নির্দ্বিধায়। তুমিও আমার চোখে চোখ রেখে কী-যে
আবৃত্তি করলে হে মধুরতমা টীকাভাষ্যহীন,
ফুটলো অপূর্ব মুদ্রা অন্তরঙ্গ আঙ্গিকে নীরবে।কথা বলি পরস্পর, মাঝে মাঝে নেপথ্যে ভ্রমণ
অবেলায়, হাতে তুলে নিই হাত, তোমার ঠোঁটের
কোমলতা পাইটের কখনো হঠাৎ আলগোছে।
আমাদের কোথায় যে নিয়ে যাবে শেষ তক এই
চোরা টান; আপাতত বুঝি না কিছুই শুধু চেয়ে
থাকি সারাক্ষণ মুগ্ধাবেশে তোমার মুখের দিকে।এরকম তাকিও না, বলে তুমি কপট শাসনে
জ্বলে ওঠো একরাশ নক্ষত্রের মতো, পরে ফের
আমার পাঁজর ঘেঁষে চলে এসে নিমেষে বুঝিয়ে
দাও কাকে বলে ভালোবাসা। তোমার ত্বকের মৃদু
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায় কী মদির।
নীরবতা গান হয়ে ওঠে, অপরূপ উন্মীলন।তুমিতো দুপুরে আছো, গোধূলিতে আমি। কখন যে
সত্তা চিরে বেজে ওঠে মরাল সঙ্গীত, জানা নেই।
আমরা দু’জন অসহায় চলেছি বিরূপ স্রোতে
ভেসে, তীর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত চোখ, তবু আশা রাখি
অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও হয়তো উদ্ধারের রূপে
উঠবে জেগে অকপটে দুর্নিবার তোমার পূর্ণিমাএভাবে কি যাবে দিন চিরদিন? ভয়ে ভয়ে থাকি,
স্থানাভাবে পথে পথে ঘুরি চুপিসারে, মাঝে মাঝে
সব কিছু তাচ্ছিল্যের ফুঁয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে চলি
হাত ধরে এ শহরে। কখনো কখনো ভাবি, তুমি
আমাকে নিভিয়ে কোনোদিন হঠাৎ যাবে কি চলে
উজাড় বাগান ছেড়ে হে আমার সর্বশেষ ফুল?যদি যাও, কেয়ামত হয়ে যাবে। পারমাণবিক
ভস্মস্তূপে নিমজ্জিত আমি চাইবো চিৎকারে সাড়া
জাগাতে, অথচ সেই আর্তনাদ শোনার মতন
কেউ বেঁচে থাকবে না আর। হাশরের ময়দানে
কেউ কারো ফরিয়াদ শুনতে চায় না, তবু জেনো
খুঁজবো তোমাকে, নাম ধরে ডেকে যাবো নিরন্তর। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | মহেঞ্জোদড়োর আসমান ফিসফিসে কণ্ঠস্বর কথা বলে
একালের উৎপীড়িত আকাশের কানে কানে
গোধূলিবেলায়। জঙ্গী বিমানের জাঁহাবাজ আওয়াজে কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায় আর্ত আকাশের।মহেঞ্জোদড়োর আসমান অতীতের প্রিয় কিছু
কথা ও কাহিনী বলে নীলিমার কানে কানে, ‘শোনো,
কী প্রভাতে, কী-বা দ্বিপ্রহরে অথবা নিশীথে মেঘ-প্রেয়সীর
ঠোঁটে কত এঁকেছি চুম্বন
নির্বিঘ্নে, করেছি আলিঙ্গন দ্বিধাহীন। এখন তো
যন্ত্রপাখি কান ঝালাপালা করে, ছিঁড়ে ফেলে বুক
মেঘেদের, ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যায় মিলনবাসর,
কত যে সাধের, হায়, এনগেজ্মেন্ট।‘মহেঞ্জোদড়োর সুপ্রাচীন আসমান ক্লান্ত স্বরে
তরুণী মেঘের কানে কানে বলে, ‘যখন নীচের
দুনিয়ার দিকে এই বুড়োটে দু’চোখ মেলে দেখি
নানা দেশে বেশ কিছু মানুষের কাণ্ড-কারখানা
পাড়ায় পাড়ায় খুনখারাবির খেল, পথেঘাটে
আদম সন্তানদের মানুষ পুড়িয়ে
মারার আ-মরি মহোৎসব, বনবাদাড়ের হিংস্র
পশুদের বড় বেশি সভ্য মনে হয়। ওগো মেঘমালা, শোনো,
আমার দু’চোখ বুজে আসছে, এই তো
এক্ষুণি আমাকে শূন্যে লীন হতে হবে।‘ (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ভোরবেলা ঘুমছেঁড়া চোখে দেখি, এ কী
ঘোর অমাবস্যা-রাত, হায়,
আমার শহরটিকে রেখেছে গ্রেপ্তার ক’রে। তবে কি সকালে
আজ এই নিঝুম দিবসে সূর্য আর
দেখাবে না মুখ? প্রকৃতির বুক জুড়ে
মহররমের নিস্তব্ধ মাতম মাথা কোটে সর্বক্ষণ।নেই, তিনি নেই, আর রাজধানী, শ্যামল পাড়াগাঁ,
মফস্বলে; জগতের কোথাও পাবে না
কেউ খুঁজে তাঁকে, যে পুরুষ
ছিলেন আকাশ-ছোঁয়া দীপ্ত অস্তিত্বের
অধিকারী। বাংলার কতিপয় শক্র তাঁর প্রাণ
করেছে হরণ তস্করের
ধরনের বিপথামী অস্ত্রধারী কুটিল আন্ধার। বুঝি তাই
অন্ধকার চতুর্দিকে বিষধর অজগর রূপে প্রতিষ্ঠিত!এই যে কখনও স্বদেশের গাছপালা, নদীনালা,
পথ ঘাট, ষড়ঋতু বুক চাপড়ায়,
অশ্রুপাত করে তাঁরই জন্যে আজও, হয়তো অনেকে
বোঝে না, পায় না টের। কেউ কেউ পায়।
তিনি তো প্রশস্ত বুকে তাঁর প্রিয় বাংলাকে ধারণ
করেছেন আমৃত্যু, সেবায় তার ছিলেন সর্বদা ব্রতী, যেমন বাগান
গড়ে তোলে রোদে পুড়ে বৃষ্টি ধারায় প্রায়শ স্নাত
হয়ে নিবেদিতপ্রাণ বাগবান। তারই কী আশ্চর্য প্রতিদান
যীশুর ধরনে পেয়ে গেলে তুমি। তবে ইতিহাস
চিরকাল মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে গাইবে সত্যের জয়গান। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যেদিকে তাকাই শুধু ধ্বংস্তূপ দেখি আজকাল।
এ আমার দৃষ্টিভ্রম নাকি
বাস্তবিকই চতুর্দিকে পরাজিত সৈনিকের মতো
পড়ে আছে? এখন এখানে যুবকেরা রাত্রিদিন চক্রাকারে
গাঁজা খায়, মধ্যরাতে কানামাছি খেলে
কখনও-সখনও, এলোকেশী যুবতীরা
নিয়ত বিলাপ করে। কতিপয় বেড়াল ছায়ার মতো ঘোরে
আশেপাশে, খাদ্যন্বেষী ইঁদুরেরা ব্যর্থ হয়ে ঢোকে
গর্তের ভেতর পুনরায়, জ্বরাগ্রস্ত মানুষের
সাধের যযাতি-স্বপ্ন চকিতে মিলায় প্রেতায়িত অস্তরাগে।এখন এখানে সূর্যাস্তের রঙ ছাড়া
অন্য কোনো রঙ নেই,
এখন এখানে শোণিতের গন্ধ ছাড়া
এখানে সাপের স্পর্শ ছাড়া আপাতত
অন্য কোনো স্পর্শ নেই,
এখন এখানে দৃষ্টিহীনতা ব্যতীত
অন্য কোনো দৃষ্টি নেই।কাউকে দেখলে কাছে দূরে সরে যাই তাড়াতাড়ি
দৃষ্টিকটুভাবে,
কেননা বন্ধুর কাছে গিয়ে দেখেছি সে বন্ধুতার
মুখোশের আড়ালে শক্রর ভয়াবহ মুখচ্ছদ
নিয়ে বসে আছে
মাছির প্রভুর মতো। কাউকে করি স্পর্শ, পাছে
সে নিমেষে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়;
আমার নিজেরই প্রতি সেই আর পূর্ণিমা-বিশ্বাস ইদানীং।দিনের অন্তিম রোদ ধ্বংসস্তূপে ব্যাপক বসায়
নখ কামুকের মতো। অদূরে চলছে ভোজ শকুনের আর
শেয়ালের ডাক
মাঝে-মাঝে অভিশপ্ত স্তব্ধতাকে করে
চুরমার; স্মৃতি আবিষ্কার করে আমি
বেনামী অস্তিত্ব খুঁজি পূর্বপুরুষের। ভস্মরাশি থেকে উঠে
শূন্যতায় ভাসে শাদা পিরহান, দাদার খড়ম।
অদৃশ্য অক্ষর লিখে অন্ধকারে আসা-যাওয়া করি;
আমার নিঃসঙ্গতায় মর্মরিত হয়
দূর শতাব্দীর হাওয়া, বয় নূহের কালের ঢেউ।ধ্বংসস্তূপে ফুল কুড়াবার জন্যে ঝুঁকতেই মনে পড়ে যায়,
বিশীর্ণ ইথিওপিয়া ক্রমশ মরছে অসহায়
দু’চোখ উল্টিয়ে। বর্তমান জীবন মৃত্যুর ভেদ লুপ্ত,
কর্কশ-বাঁশির তালে-তালে গলা ছেড়ে
আমাকে গাইতে হবে গান। সুর যত
ওঠে উচ্চগ্রামে, তত রক্ত ঝরে বুক থেকে; ধ্বংসস্তূপে গান
গাইলে নিশ্চিত বুকচেরা রক্ত ঝরাতেই হয়,
এই রক্তধারা যায় ছায়াপথে, নক্ষত্রের দিকে। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | অকস্মাৎ লেখার টিবিল থেকে যদি
আমাকে উপড়ে নেয়, ঘর গেরস্থালি, প্রেমিকার একরাশ
চুলের সৌরভ, সন্তানের চুমো জনপথ, কবিসভা থেকে
ঝোড়ো হাওয়া এক ফুঁয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়
পালকের মতো, হাতলে কি এ শহর হয়ে যাবে
ধনুকের প্রোজ্জ্বল টংকার?এ রকম কিছুই হবে না। যে মচ্ছব সালঙ্করা
গণিকার অঙ্গভঙ্গি, তাতে ভাটা
গড়বার লক্ষণ দুর্লক্ষ্য আপাতত। কত নির্ঘুম রাত্রিরস্মৃতি আনে কর্কশ অস্বস্তি। সর্বদাই
নির্ঘুম কবির চোখ, অবসাদে, ক্লেশে
দু’চোখের পাতা জোড়া লাগলেও অন্য চোখ
জেগে থাকে, দ্যাখে
রাত্রির তৃতীয় যামে চাঁদ হাঁটে নীলিমার দবিজ কার্পেট,
ফুটপাতে ঘুমন্ত শিশুর
কপালে নিবিড় টিপ দিয়ে যায় খুব চুপিসারে।
তোমার সৌন্দর্য, হে স্বদেশ, আকৈশোর মুগ্ধ আমি
অনিন্দ্য ফুলের মতো তোমার এ মুখ
উন্মীলিত, যেখানেই যাই
তোমার মুখশ্রী সঙ্গী আমার এবং
দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের ঘোর কেটে গেলে
তোমার রূপের টানে ফিরে আসি তোমার কাছেই।
আমাকে কখনো যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে দূরদেশে
কী ক’রে বাঁচব আমি তোমাকে না দেখে? ভাবি খুব
উদাসীনতায় ডুবে থাকব, অথচ
দুখিনী তোমার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।হে অনিন্দ্য ফুল,
তোমার ভেতরে ওরা ছড়িয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো
কীট, কালিমার গাঢ়ঝ, পোঁচড়া পড়েছে
তোমার চোখের নিচে, তবু কী সুন্দর
তুমি, রোগ শোক অর্ধাহারে। কত নোংরা
হাত সাপ হয়ে নাচে ডোরাকাটা শাড়ির চৌদিকে,
চায় দরবারি স্খলিত বসনে দেখে পেতে লালসার যৌথ বাহারের ভাগ।তোমাকে বন্ধক রেখে পেট্রোডলারের খাদেমেরা
নিটোল মুক্তোর মতো নিজেদের আখেরকে সাততাড়াতাড়ি
পৌঁছে দেয় সাত আসমানে। স্থিতি নেই
কোনোখানে, আঙনের কোলাহলে দিশেহারা মানুষ, বনের
পশুপাল আমার জীবন ঘূর্ণিজলে
পাতা যেন, ডোবে আর ভাসে।এই ডামাডোলে
যার রাজবেশ তার প্রত্যাবর্তনের উপলক্ষে
অসংখ্য তোরণ তৈরি হয় প্রধান শহরে, তাকে
বরণ করার জন্যে সভাসদদের
তুমুল উদ্দীপনায় শূন্য হয়ে যায় সব ফুলের নার্সারি।
জনসাধারণ বিস্ময়ের
চূড়ায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে, কবি দ্যাখে তার
কবিতার ছন্দ ভুলে, শোনে
একটি তোরণ থেকে ভুখা শিশুদের
কান্না ভেসে আসে,
আরেকটি থেকে রাজবন্দিদের দীর্ঘশ্বাস স্বৈরাচারীদের
বিরুদ্ধে ঘৃণার উচ্চারণ,
কোনো কোনো তোরণের চিত্রিত গা বেয়ে
চুইয়ে চুইয়ে পড়ে গত ধর্মৎটে শহীদের
পবিত্র শোণিত। এরই মধ্যে নানা ডৌলে
শব্দ লিখি, ছন্দ গেঁথে যাই আর দশদিকব্যাপী
অন্ধকার থেকে
একমুঠো কালো তুলো নিয়ে
ব্যাজ পড়ি, যা নয় কখনো পরবশে,
কিংবা কারো একলার নয়। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | দেখছি এখন এই খানিক দূরেই পথে এক
বেজায় জখমি লোক প’ড়ে আছে আর
একটি কুকুর তার পাশে ঘোরাঘুরি ক’রে
শুঁকছে আহত প্রাণীটিকে। জখমি পথিক প্রাণহীন।এমন সময় আসে যখন শহরে আর গ্রামে
সামান্য কথায় কোনও মানুষ অপর মানুষের
প্রাণ কেড়ে নেয় যেন গাছের সামান্য পাতা-
এভাবেই কত-যে প্রাণের হয় অবসান
খবর রাখে কি কেউ? হয়তো রাখলে নিয়মিত
অনেক বিশাল খাতা দিয়ে ঢের ঘর ভ’রে যেত।কে তুমি এখন এই আমার আঁধার-হয়ে আসা
কালে এলে জেনে নিতে আমার গোপন
কথাগুলো খুঁচিয়ে জেনে নিতে? যাও তুমি
চ’লে যাও। যেটুকু শান্তির মৃদু হাওয়া বয়ে যায়
অন্তরে নীরবে তাকে বইতে দেয়ার পথে ছুড়ে
দিয়ো না পাথর এই শান্তির চরণে।এখন আমরা যাব দূরে, বেশ দূরে-
যেখানে মানব-শক্রদের শয়তানি,
নানাবিধ হয়রানি শেষ করে সারাক্ষণ মঙ্গলের
পথে হেঁটে যাবে, যদি কোনও পথ কেউ
আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ভেঙে ফ্যালে ঘরবাড়ি
তা হ’লে তাদের অপরাধ শাস্তির বেতের বাড়ি
সুদীর্ঘ জেলের ভাত খেতে-খেতে কাটাবে সময়! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | শোকমূলক | শাহ এম এস কিবরিয়া নামটি যখন
উচ্চারিত হয় এমনকি মৃদুভাবে,
একজন গুণবান মানব জৌলুস নিয়ে
নিমেষে ওঠেন ভেসে দৃষ্টিপথে আজও আমাদের।শিক্ষার আলোয় তিনি উদ্ভাসিত ছিলেন ব’লেই
মানুষের অগ্রহতি, কল্যাণ-কামনা
ছিল তাঁর ভাবনার প্রধান বিষয়। তাঁকে শাহ
কিবরিয়া ব’লে মনে দিয়েছিল ঠাঁই ভালোবেসে।অথচ শক্রর দল হিংসায় উম্মত্ত হয়ে এই
গণহিতকামী পুরুষের গৌরবের
আলোয় হিংসায় সেই পুরুষের জীবননাশের
কূট মতলবে তাঁর বুকে হানল মৃত্যুর ক্রূর ছোপ।শাহ এম এস কিবরিয়া মুছে যাবেন ভেবেই
যারা তাঁর বুকে হেনেছিল ছোরা কী-যে মূঢ় ওরা।
কেননা ওদের জানা নেই শাহ এম এস কিবরিয়া
যারা, তারা মরে না ছোরা কিংবা অন্য অস্ত্রাঘাতে! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই,
করাঘাত হওয়া ভালো। যদি
কোনো বন্ধু-বান্ধব হকার কিংবা গয়লা
আমার আপন দরজায় এসে কড়া নাড়ে কখনো সখনো,
খুব ভালো হয়।
কিন্তু কেউ চুপচাপ এসে চলে গেলে বন্ধ দোরে
রেখে গেলে এক গুচ্ছ ফুল
কিংবা চিরকুট শব্দহীন,
আমি সেই উপহার কখনো গ্রহণ করবোনা।
আমি তো আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে আচমকা
করাঘাত চাই।নইলে চতুর্দিকে ব্যস্তবাগীশ উইয়ের ঝাঁক ‘প্রভু প্রভু’ শব্দে
গড়বে বল্মীক কতো, আমি
অতিশয় ঢাকা পড়ে যাবো।বৃক্ষের ছায়ায় ভিন্ন গাছ
পক্ষীর ডানায় অন্য পাখি
তটিনীর গহনে অপর নদী দেখে, মৃত্তিকায়
নক্ষত্রের গুঁড়ো মেখে, গন্ডদেশে ধেনো শিল্পরসের উদাস
চটচটে দাগ নিয়ে খোয়ারিতে ম’জে
বসবাস করতে করতে আজীবনের সঙ্গে তুই তোকারিতে মেতে
অনেক সোনালি সুতো ছিঁড়ে খুঁড়ে
জীবনেরই বিরুদ্ধে বিপ্লবী হয়ে যাই।
তখন আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই।কৃষ্ণকলি নৈঃসঙ্গ্যের ওষ্ঠ থেকে ওষ্ঠ তুলে
কখনো বলিনা-
লোকালয় আমার ভেতর
প্রবেশ করুক।
আমার নিজের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্যের মতন
রেখেছি যেসব উপদ্রব জমা, তাড়ানো সহজ নয় তাদের কখনো;
ওদের বিশদ তাড়নায় আমি রণক্ষেত্রে পারতাম যেতে
পারতাম মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ফোয়ারা খুলে দিতে,
পারতাম মেরু অভিযানে হতে স্কটের দোসর, পারতাম
সইতে ক্রূর তুষার-কামড়।কিন্তু শুধু সারাবেলা মগজে ভ্রমর নিয়ে পুরোনো চৌকাঠে
চন্দন বুলোই, ফুলপাতা হয়,
কখনো কারুর
অলৌকিক মুঠোয় নিমেষে চলে যাই বার-বার।
সেই মুঠো থেকে
কখনো সখনো আমি নিষ্কৃতি প্রার্থনা করি ব’লে
আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কখনো কখনো মনে হয় আট কোটি লোক শোনে
আমার নিভৃত উচ্চারণ, কখনো-বা মনে হয়
আমার কথার জন্যে পিপাসার্ত একজনও নয়।
প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অত্যন্ত একাকী গৃহকোণে
বসে শব্দ দাও শব্দ দাও বলে কী গহন বনে,
পর্বতে, পাতালে হই নতজানু, করি আয়ুক্ষয়
প্রতীকের প্রতীক্ষায়, কম্পমান একটি হৃদয়
বিজন সৈকতে সারাক্ষণ রহস্যের ঢেউ গোনে।যে-কথা হৃদয়ে ফোটে, হৃদয়ের ধ্বনির মতন
অন্তরঙ্গ বেজে ওঠে, তা যদি না শোনে কেউ কান
পেতে কিংবা না বোঝে কখনো, ক্ষতি নেই, নেই খেদ।
তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা করি উচ্চারণ,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান;
মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | আমার জীবন কখন যে আচমকা
মুছে যাবে, জানা নেই। হোক না যখনই,
দৈবক্রমে যদি দুনিয়ায় ফিরে আসি
হাজার বছর পর শ্যামলীতে, তখন কি খুঁজে
পাবো এই আমার নিজের বাড়িটিকে? কিছুতেই
পড়বে না দৃষ্টিতে বিনীত সেই বাড়ি। বহুতল
শৌখিন মহল কোনও করবে বিরাজ সেই স্থানে। হয়তো-বা
আগেকার চেনা জায়গাটা, মাথা কুটে মরলেও, চিনবো না।আমার নিজের বংশধর কেউ চিনে নিয়ে এই
আমাকে স্বাগত
জানিয়ে শ্রদ্ধাত আভা ছড়িয়ে সানন্দে বসাবে না
অপরূপ আসনে এবং
আমার দু’চোখ ভিজে যাবে কি তখন ঠিক মানুষের
মতো নয়, অথচ মানব-সন্তানের
বিকৃত ধরনের গড়ে-ওঠা জীব যেন নিয়মিত
ওঠে বসে, হাঁটে আর দরজা, জানালা বন্ধ করে, খুলে দেয়সম্ভবত বিলুপ্ত আমার বংশধর। বৃথা আমি
উঠবো সন্ধানে মেতে তাদের কাউকে
এবং হাঁটবো ডানে বামে। প্রশ কি করবো
কখনও সখনও পথচারীদের? নিরুত্তর চলে যাবে ওরা
যে যার গন্তব্যে। প্রকৃতই আছে কি গন্তব্য কোনও?
‘নেই, নেই’ ধ্বনি শুধু কানে এসে ঝরে যায় নির্বাক ধুলায়।এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখি শুধু পাথরের
ঘরবাড়ি, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, হায়,
নেই কোনও গাছ-গাছালির
এতটুকু চিহ্ন কোনওখানে। মাঝে মাঝে
চোখে পড়ে পাথরের মূর্তি কিছু সাজানো, গোছানো;
দোকানে পসরা ঢের, অথচ কোথাও এক রত্তি ফুল নেই।এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? বৃষ্টিধারা
কস্মিনকালেও স্নান করিয়ে দেয় না
এই শহরকে, শুধু ধু ধু তাপে বেঁচে আছে এই
নগরের বাসিন্দারা সব, পুতুলের মতো ওরা
পারে না ওঠাতে মাথা কিছুতেই মহীয়ান
লৌহমানবের প্রিয় হুকুমবরদারদের ত্রাসে
দিনরাত। বেহেস্তে করছে বসবাস, সদা মেনে নিতে হয়।মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি সারাটা শরীর
ঘামে ভেজা, রাতের স্বপ্নের দানে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ি। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কিয়দ্দূরে ইঁদারার কাছে দেখি একটি তরুণী
পেয়ারা গাছের পাতা ছোঁয় মমতায়,
তার শরীরের চমকিত
মুদ্রায় তোমার উপস্থিতি ভেবে কাছে যাই; ভুল ভেঙে যায়।একটি মেয়েকে দেখি রেস্তোরাঁয় বসে আছে একা;
কফির পেয়ালা শূন্য, দু’টি হাত টেবিলে স্থাপিত।
তাকে তুমি ভেবে প্রায় বলে ফেলি, ‘ভীষণ লজ্জিত, কতক্ষণ
বসে আছো?’ নিজের বিভ্রমে লজ্জা পাই।একদিন মফস্বলী ইস্টিশানে কুয়াশার রাতে
ওয়েটিং রুমে তুমি বসে আছো বিষণ্ন, সুন্দর।
কোথায় চলেছ, কত দূরে? কুয়াশা তোমাকে গিলে খেলো, দেখি
অপরিচিতার হাই; নিষ্প্রভ রাত্রির দিকে খানিক তাকাই।বেশ কিছুদিন পর সেদিন বিকেলবেলা তোমার নিবাসে
নিভৃত ড্রইংরুমে বসে আছি অস্থির, ব্যাকুল।
তুমি এলে, ট্রলিতে চায়ের সরঞ্জাম; কথা হলো
নিছক মামুলি কিছু। এ কাকে দেখছি? হায়, তুমি নও তুমি। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ভাবিনি চলার পথে এত বেশি কাঁটা
এবং পাথর বারবার
আমাকে ভোগাবে নানাভাবে। ছেলেবেলা
যখন পিতার আর মাতার মমতা
আমাকে রেখেছে নিত্য ঢের
কষ্ট থেকে মুক্ত, জেগেছেন সারারাত।বেশ আগে পিতামাতা আমাকে সংসারে
রেখে চ’লে গেছেন ওপারে
জীবনের। সত্য কথা করি উচ্চারণ
আমার নিজের প্রায় শেষ-বেলায়-এখন
বস্তুত তাদের কথা প্রতিক্ষণ মনে পড়ে না কিছুতে
মাঝে-মধ্যে পড়ে আর কখনও-সখনও অশ্রু ঝরে।নিজেও জনক আমি একজন যার
ছোট এক ছেলে হারিয়েছে প্রাণ জলাশয়ে
সাঁতার জানেনি ব’লে। কখনও-সখনও
মনে হয়, বেজায় করুণ সুরে ডাকে সে আমাকে
ভুলে-থাকা মেঠো-পথে। তখন নিজেকে
বড় বেশি অসহায়, এমনকি কেমন নিষ্ঠুর মনে হয়।আমার সে-সন্তানের মাকে ভুলেও কখনও তার
ছেলেটির কথা তুলে দুঃখ দিতে চাই না কিছুতে।
কখনও-সখনও কী-যে হয়, সন্তানের
অভিমানী মুখ আজও তাকায় আমার দিকে। আমি
ভীষণ লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলি, চুল
ছিঁড়ি বারবার আর জলাশয় হাসে ক্রূর হাসি! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | জাভেদ, তোমাকে আমি ডাকছি এই সাতসকালে,
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে,
তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
জাভেদ তুমি টইটম্বুর বাসে
বাদুড়ের ধরনে ঝুলে যাচ্ছ।
কী দরকার ছিল এত কষ্ট করার,
পরের বাসে গেলেই তো পারতে!তোমার কি এতই তাড়া ছিল?
আর ক’টি মিনিট
অপেক্ষা করতে পারলে না।জাভেদ তুমি কোথায় চলেছ সবুর বিহনে?
জাভেদ, আমি তোমাকে মনে করে
অন্য কাউকে ডাক দিইনিতো? ইদানীং
এ এক দারণ মুশকিল, বুঝেছ জাভেদ,
চট্জলদি একজনের সঙ্গে
আরেকজনের তেমন তফাৎ
খুঁজে পাওয়া যায় না, যেমন ঝানু নিকেরির ঝাঁকায়
একটি মাছকে খুব আলাদা ভাবা যায় না।আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি জাভেদ,
ঐ চোখ, ঐ কপাল আর ঢেউখেলানো চুল-
কী করে ভুল হবে আমার?
তুমি আমাকে, এই উনিশশো তেরাশির আমাকে
চিনতে পারনি হয়ত।
আমি কি খুব বেশি বদলে গিয়েছি?
নইলে কেন তুমি একটু
থমকে দাঁড়ালে না, করলে না অপেক্ষা? নাকি
চিনতে পেরেওপড়ি মরি করে বাদুড়ের ধরনে
ঝুলে পড়েছ বাসের হাতলে। জিম্নাসটিকে
এত ভাল তুমি, আমার জানা ছিল না।যাদের খুব তাড়া থাকে, তারা আশেপাশে
ভাল করে তাকায় না; উপরন্তু
চেনা মানুষকে ওরা অচেনা বানাতে পারে
চোখের পলকে।জাভেদ, নিমেষের জন্যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে,
মনে হল। তারপর কী যে হল, পাকা অভিনেতার মতো
তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে। আমিও সাহস করে
ছুটে যাইনি তোমার দিকে,
পাছে বিব্রত হতে হয় আমাকে।জাভেদ, আমি তোমার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
অপেক্ষা করে থাকব।
তোমাকে দেখে আমি কারো পা মাড়িয়ে,
কাউকে গুঁতিয়ে অমন ঠেলেঠুলে
চলন্ত বাসে উঠে পড়ব না অথবা
চিনতে পেরেও বেমালুম না চেনার ভান করব না।আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করার পারব।
আমি অপেক্ষা করতে পারি
একটি গোলাপ কুঁড়ির উন্মীলন দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
পক্ষীশাবকের প্রথম ওড়া দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
শিশুর কচি মুখের প্রথম বুলি শোনার জন্যে;
কোনো মুমূর্ষুর চোখের তারার নিভে- যাওয়া দেখার জন্যে,
কবিতার হারানো পংক্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে
আমি অপেক্ষা করতে পারি। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হে নির্বোধ, কে তুই রঙিন পঞ্জিকা খুলে ব’সে
আছিস সে কবে থেকে? কেন ক্যালেন্ডারের তারিখে
নির্নিমেষ দৃষ্টি তোর খরাদগ্ধ, বর্ষণপ্রত্যাশী,
নিঃস্ব কৃষকের মতো? যার প্রতীক্ষায় তুই এই
অবেলায় রেখেছিস দোর খুলে, মানে না সে কোনো
পঞ্জিকার নির্দেশ কখনো, ক্যালেন্ডারের সংকেত
সর্বদা অগ্রাহ্য তার কাছে। আছে তার স্বরচিত
রীতিনীতি, যদি তাকে বাস্তবিক রীতি বলা যায়।কখন পড়বে তার পদচ্ছাপ কোন সে চৌকাঠে,
সহজ নয় তা’বলা। কী খেয়ালে মেতে সে চকিতে
শ্রদ্ধাস্পদ, ধীর অধ্যাপকের বিরলকেশ, দামি
মাথায় কৌতুকী গাট্রা মেরে বিহ্বল, বিবরবাসী
যুবকের মগজের কোষে ছড়ায় অনল আর
তার শিকারির মতো হাতে দেয় বাসরের ফুল। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।
এখন তো তিনি নেই, তবু সেই ধ্বনি আজ শুধু
তাঁরই কথা বলে;
মেঘনা নদীর মাঝি যখন নদীতে
ভাটিয়ালী সুর তোলে, তার
পালে লাগে দীর্ঘদেহী সেই পুরুষের দীর্ঘশ্বাস,
যখন কৃষক কাস্তে হাতে
ফসলের যৌবনের উদ্ভিন্ন উল্লাস দেখে মাতে,
তখন মহান সেই পুরুষের বিপুল আনন্দধ্বনি ঝরে
ফসলের মাঠে,
যখন কুমোর গড়ে মাটির কলস, ঘটিবাটি,
নানান পুতুল চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে,
তখন সৃজনশিল্পে তার
জেগে ওঠে মহান নেতার স্বপ্নগুলি,
উচ্ছ্বসিত লাউডগা, কচুপাতা, কুয়োতলা, পোয়াতি
কুমোর বউ।
ওরা তাঁকে হত্যা ক'রে ভেবেছিল তিনি
সহজে হবেন লুপ্ত উর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়,
মাটি তাঁকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে-
কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে
এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দীপ্র উচ্চারণে,
সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে,
শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের
আন্দোলনে,
রৌদ্রঝলসিত পথে মহামিছিলের পুরোভাগে। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | বেলা তো অনেক হলো। এরই মধ্যে গুছিয়ে ফেলার
কথা ছিল সব কিছু। অথচ কেমন
অগোছালো পড়ে আছে সংসার এবং
কবিতার ঘর, যেন কোনো
দুষ্ট বালকের দস্যিপনায় পাখির বাসা খুব
তছনছ হয়ে আছে
বিষণ্ন ধুলোয় এক কোণে। পথচারী
উপেক্ষার কিছু ছাই ছড়িয়ে গন্তব্যে চলে যায়।আশা ছিল, যেটুকু হায়াত আছে বাকি,
বিকেলের রোদ, জ্যোৎস্না, পাখিদের ওড়াউড়ি আর
গাছ গাছালির সবুজাভা, মেঘ দেখে
বই পড়ে, শিশুদের ছোটাছুটি, আপনজনের
কথা উপভোগ করে, কবিতার অন্তঃপুরে ব’সে
নিশ্চিন্ত কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমি আজ
হঠাৎ লুণ্ঠিত মানুষের মতো নিঃস্ব, প্রায় নগ্ন,
বাইরে প্রচণ্ড শীতে বৃষ্টিতে কাঁপছি হি হি এক
অবোধ শিশুর হাত ধরে। হায়, আমার ভুরুর মাঝখানে
যে অদৃশ্য চাঁদ আছে তা-ও কি আখেরে নিভে যাবে? (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কেউ কি এসে কবির এমন ক্ষয়া জীবন-গোধূলিতে
গান গেয়ে আজ পুঁতবে খুঁটি কবির প্রাণের খোলা ভিতে।
কৃষ্ণপক্ষে আজকে যাদের জীবন কাটে স্মৃতি নিয়ে,
কে-বা চাইবে সুখী হ’তে স্মৃতির জালটি ছিঁড়ে দিয়ে?ক’দিন ধ’রে মুষড়ে আছি একলা নিজের ছোট ঘরে,
ভুগছি আমি, কাঁপছি এবং পুড়ছি বেজায় কালো জ্বরে!
কেউ কি আমায় বলতে পারো শান্তি কোথায় পাবো কিছু?
কোথায় যেতে হবে না আর ক’রে আমার মাথা নিচু?যেদিন থেকে ভাবি না আর তোমার মুখের হাসি, কথা
মনের গুহায় গুমরে মরে অনেক কথা, রাঙা ব্যথা।
হয় না বলা সেসব কথা কারো কাছেই ডেকে ডুকে,
তোমার কথা স্মৃতির পাতায় নিয়েছিলাম সুখে টুকে।পরে যেদি আমায় হেসে প্রশ্ন করো, ‘গ্যাছো ভুলে?’
নীরব থেকে দৃষ্টি দেবো হরিণ-চোখে, কালো চুলে।
জানি আমি অনেক কথাই বলার জন্যে বলি শুধু,
হৃদয় জুড়ে অনেক সময় মরুর বালি করে ধুধু।
|
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আবহাওয়া দপ্তর প্রচার করেছে, ঝড়ের
তেমন কোনও সম্ভানাই নেই; তবু লেখার
টেবিলে কাগজ কলম নিয়ে ব’সে কেন জানি না
বার বার মনে হচ্ছে, তুমুল তুফান হঠাৎ
আসবে ধেয়ে চৌদিক থেকে প্রচণ্ড
ঝাঁকুনি দিয়ে। বাড়ির সবার জন্য আশঙ্কা
শাঁকচুন্নির মতা ভীষণ আঁকড়ে ধরেছে
আমাকে বুকে বড় বেশি চাপ কী করি? কী করি?নিঃশ্বাস নেয়া ভার, এক ঝটকায়
খানিক মুক্তির জন্য হয়ে পড়ি বেপরোয়া, অথচ
দেখছি এক অন্ধকার কুঠুরির খড়বিচুলিতে গড়িয়ে
গড়িয়ে গোঙাচ্ছি। আচমকা চোখে পড়ল,
চৌদিকে পড়ে আছে অসহায়, নিস্তেজ
ক’জন লোক; এক ঝাঁক হিংস্র ছুঁচো আর ইঁদুর
তেড়ে আসছে আমাদের ছিঁড়ে খাওয়ার
অপ্রতিরোধ্য তাগিদে। পড়ি মরি বাঁচি দিই চম্পট।
দিনদুপুরে চেয়ারে বসেই কি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন
দেখছিলাম? নাকি আগামীর কোনও সম্ভাব্য
ঘটনার আভাস ফুটে উঠেছিল অলক্ষুণে সুদীর্ঘ
তন্দ্রায়? কে আমাকে বলে দেবে? হায়, এই পোড়া মাটিতে
কখনও কি দেখে যেতে পারব না এরকম বাগান,
অপরূপ, বিচিত্র পুষ্পরাজি যার সকল
মানব-মানবীর হৃদয়ের ক্ষত করে দিতে পারবে
নিরাময়? আমরা কি পাব না শুনতে নতুন সৃষ্টির অর্কেস্ট্রা? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | সেদিন দুপুরে বিদেশে যাবার আগে
প্রায় নিজে যেচে গেলাম তোমার বাড়ি।
বারান্দা থেকে আমাকে দেখেই তুমি
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে তাড়াতাড়ি।‘কেমন আছেন? এখানে বসুন এই
সোফাটায়, কী-যে ভালো দুপুরটা আজ।
কী দেবো এখন? দেবো কি ঠাণ্ডা কিছু?
‘কিছুই খাবো না। বাড়বে তোমার কাজ।‘আমার তুচ্ছ কথায় কান দিয়ে
নিয়ে এলে কিছু খাদ্য এবং দামি
বীয়ারের ক্যান। জীবনের মতো ক্যান
নিমেষে ফুরোলো, ঈষৎ হেসেই থামি।‘কেন যে আপনি বলেন না কিছু?
কত লোক শুনি কথা বলে রাশি রাশি
অথচ আপনি নিজের মধ্যে ডুবে
থাকেন শুধুই, আপনি স্বল্পভাষী।‘আমিও নীরবে মেনে নিই অপবাদ।
‘অমন আপনি আপনি কর যে তুমি
তা হ’লে কী ক’রে ফুটবে কথার ফুল?
কীভাবে ভরবে সুরভিতে মনোভূমি?হাতে হাত রেখে বললে মধুর স্বরে,
‘সহজে আসে না ছোট্র এ তুমি, মাফ
ক’রে দাও, আর কখনো হবে না ভুল।
পেয়ে যাই তার হৃদয়ের উত্তাপ।বলি তার কানে ‘রোজ এই অভাজন
ব্যাকুল বাজায় তোমার নামের বাঁশি
মাটিতে আকাশে সকল সময়, তবু
আমাকেই তুমি বলবে স্বল্পভাষী?’ (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | মধ্যরাতে কোনার ছোট ঘরে টেবিল-ল্যাম্প
জ্বলতেই আমার কলম বিরক্তিতে
বেজায় খুসখুস করতে লাগল
ডান হাতের তিন আঙুলের চাপে।
কলমটিকে যত রাখতে চাই টেবিলে
ততই যেন ওর জেদ চেপে যায়, সরে না
কিছুতেই। কে যেন জেদ ধরেছে
শূন্য পাতাটি ভ’রে তুলবেই অক্ষরে।যতই কলমটিকে লুকিয়ে রাখতে চাই চোখের
আড়ালে টেবিলের ড্রয়ারে, কিছু
বইপত্রের নিচে কবর দিয়ে তত বেশি লাফিয়ে
ওঠে সে আমার হাতে। মুচকি হাসে যেন বেজায়
পেয়েছে মজা। কলমের কাণ্ড দেখে হাসব
নাকি কাঁদব ঠিক করা মুশকিল ভীষণ। মনে হল,
অদূরে গাছের ডালে এক হল্দে পাখি আমার
দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে কৌতুকী হাসি।পাখিটি কি ভাবছে ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া লোকটা
জীবনের প্রায় শেষ সীমানায় পৌছে ভীষণ
হাবুডুবু খাচ্ছে? গাছতলায় এসে গলায়
দেবে কি দড়ি? কে জানে? আবার আনন্দের
কত মেলা বসে নানা দিকে-আলোর ফোয়ারা ফোটে।
এই তো আরও আচানক দিগ্বিদিক যুবক, যুবতী
জ্বলজ্বলে নিশান কাঁধে নিয়ে হতাশার তিমির
তাড়িয়ে বালক, বালিকা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধার মুখে ফোটায় হাসি। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আঙুল বুলিয়ে শূন্যে নিদ্রাহীন রাতে শুদ্ধ সাঙ্গীতিক ধ্যানে
কবিতার কথা ভাবি। কে যেন সোনালি জলধারা
কেবলি গড়িয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য সুরাই থেকে; আঁজলা পেতেছি
ঝাঁক ঝাঁক সজারুর বিরোধিতা করে।কবিতা দেখাতে পারে মাঝে মাঝে ক্লাউনের খেলা
হলঘরে ঝাড় লণ্ঠনের নিচে, আবার কখনো
কবিতা চটিয়ে দিতে পারে ময়-মরুব্বিকে রকবাজ যুবার ধরনে;
কোনো কোনো কবিতার প্রকৃতি বিষাদে ছায়াচ্ছন্ন অতিশয়।
কখনো কবিতা। সুরামত্ত নাবিকের মতো গান
গেয়ে ওঠে রাঙা গণিকার গলা জড়িয়ে। আবার
কখনো উদাস দরবেশ যেন ঘূর্ণি নাচে এবং মস্তিতে
ভরপুর; কোনো কোনো কবিতার এমনই স্বভাব,
শিশুর সারল্যে প্রজাপতিদের রঙিন পেছনে ছোটে, ভাঙে
বাবুই পাখির বাসা। কোনো কোনো কবিতার বুকে
বিলের হাঁসের উষ্ণ বুকের স্পন্দন শোনা যায়।
কখনো কবিতাবলি সংবাদপত্রের দিকে পিঠ দিয়ে বেড়ালের চোখে
বিশ্বরূপ দ্যাখে, খরগোশের মতো লাফিয়ে বেড়ায়
ঘাসে ঘাসে, কখনোবা কমলালেবুর রস হয়ে
রোগীর তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে ঝরে যায়, ইবনে সিনার
মনীষার মতো জ্বলজ্বলে, সদ্য তন্বী, গানে-পাওয়া।কোনো কোনো কবিতা রহস্যময় বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে
জ্যোৎস্না রাতে কোনো কোনো কবিতাকে মনে হয় একান্ত পথিক
ধুলোময় পায়ে দূর তীর্থে চলেছেন একা। কোনো কোনো
কবিতা প্রকৃত
বিপ্লবীর মতো তার প্রিয়তমা রমণীর স্তনচূড়া, নাভিমূল থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বয়ম্ভর দুর্গম টানেলে সরে যায়।
কোনো কোনো কবিতা কী সুখে ঘর-গেরস্থালি করে,
কখনো কবিতা এক মুখ ব্যান্ডেজের ফাঁকে দুই ফোঁটা চোখ,
কোনো কোনো কবিতা কখনো উপদ্রুত এলাকায়
ত্রাণ সামগ্রীর মতো সেবাপরায়ণ। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |