poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান | রূপক | কত দীর্ঘকাল আমি শেফার্স করি না ব্যবহার।
ফলত হাতের লেখা, মনে হয়, ক্রমশ খারাপ
হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমার লেখার সুচিহ্নিত
চরিত্র বদলে গেছে, বলা যায়। এরকম ক্রীড়া-
পরায়ণ ধারণা আমার মনে সীলমোহরের
স্পষ্ট ছাপ কেবলি বসাতে চায়। হয়তো এর কোনো
মানে নেই; সংস্কার পাখির মতো ডেকে ওঠে লাল
রক্তের ভিতরে। বলপেনে ভাষাচর্চা কী রকম
ফুলচন্দনের ঘাণপায়ী হতে পারে, জেনে গেছি।
ধরেছি ঘরের ভাষা সুদূর প্রবাসে কাগজের
ব্যাপক শাদায়, পাই নিদ্রিত বনের বিষণ্নতা।
প্রকৃত রন্ধনশিল্পী যিনি তার কাছে কড়াইয়ের
আকার প্রকার স্রেফ অবান্তর। কোনো কোনোদিন
মনে হয়, একটি শেফার্স পেলে বড় ভালো হতো। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কিছুক্ষণের জন্যে, এই ধরো চব্বিশ-ঘণ্টাব্যাপী, একটা জোয়ার
এসেছিল। লোকগুলো আনন্দ। টগবগে ছন্দোমায় কোনো কবিতা
যেমন মাতিয়ে রাখে সবাইকে, তেমনি। একটি নৌকা,
ছিপছিপে, ঔদার্যে অলংকৃত, জলে ভাসতে ভাসতে ওদে,
যারা তীরে দাঁড়িয়ে দূরে থেকে দেখছিল খেলাচ্ছলে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৌকায় দোলা, বলে, “অনুপম সূর্যোদয়
দেখাব তোমাদের। তোমরা ভরাট গলায় জয়ধ্বনি দাও”।
নদীতীরে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলোর মনের গহনে তখনো
সূর্যোদয় দেখার সাধ আড়মোরা ভাঙেনি। নৌকা
মানুষের নিঃস্পৃহতার ধূসর ধাক্কায় অনেকক্ষণ ঘুরপাক
খেলো মাঝ-নদীতে। তারপর জলকন্যার মতো দিলো ডুব।
প্রতিশ্রুতি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে মুক্তোর দ্যুতি ছড়ায়। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | যখন কখনো চণ্ডীদাস মধ্যরাতে নক্ষত্রের
দিকে তাকাতেন, মনে হয়, তখন দু’চোখ তাঁর
বাষ্পময় হয়ে উঠতো, অকস্মাৎ নামহীন ভয়
করতো দখল তাঁকে; হয়তো নিঃসীম শূন্যতা দেখে
ভূমণ্ডলে, নভোমগুলের স্তরে স্তরে, অস্তিত্বের
তন্তজালে, শিহরিত হতেন নিজের অগোচরে।
অথবা তখন দেখতেন প্রথম কদম ফুলে
ক্ষয়চিহ্ন, রজকিনী প্রেমের সম্ভাব্য নশ্বরতা
করতো কি বিচলিত তাঁকে? দূরাগত কোকিলের
আর্ত ডাক তাঁর পদে কীসের অস্পষ্ট গুঞ্জরণ
ব্যাকুল মিশিয়ে দিতো! অনাগত সময়ের ধ্বনি?
হতে পারে, নিঃস্ব কবি একদিন হেঁটে যেতে যেতে
দেখলেন মাধ্যাহ্নিক ভস্মরাশি নিয়তির মতো
তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। অপার ঔদাস্যে তিনি,
নাকি বিলুপ্তির অন্ধ ভাবনায় ভেসে পুকুরের
ঘাটে এসে বসলেন চুপিসারে। সবার উপরে
সত্য যে মানুষ তার ভিড় কিংবা খুব একা কেউ
মনের ভেতরে তাঁর নৈঃশব্দকে করে গান। তিনি
গুঞ্জরিত মনে গিয়ে গৌরী ধোপানীর সন্নিকটে
নিঃস্বতাকে বানালেন অপরূপ স্মৃতির ভূষণ। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | চারদিক থেকে ধুলোর বৃষ্টি; দু’হাতে মুখ ঢেকেও
দৃষ্টি খোলা রাখতে ব্যর্থতা পোহাচ্ছি। ব্যর্থতা যেন
গোর খোদকের মত নৈপুণ্যে চাপ চাপ ধুলোর কবর
তৈরি ক’রে আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ভেতরে। দম বন্ধ
হয়ে আসছে আমার। কঙ্কালেরা ঘিরে ধরেছে তাণ্ডবে,
হাল ছেড়ে মুখ ঢেকে পড়ে থাকি, করি মুর্দার অভিনয়।হন্তারকের বিকট উল্লাস ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত এখানে
সেখানে; স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া উচিত ছিল, অথচ
যেতে পারি না এই চেনা প্রকৃতির কোমল রূপ, মাটির
মাতৃসুলভ মমতা ছেড়ে। এই শহরের শ্বাস-প্রশ্বাস আমাকে
বাদ্যের মত বাজায়, নদীর ঢেউয়ের মত দোলায়। দুলতে
দুলতে স্নেহার্দ্রে চোখে তাকাই চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধার দিকে।আমার বাঁচার আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র ধু্লোর
ঝাপটা, শোকবার্তা অনবরত কালো করতে থাকে শহর
আর গ্রামকে। ফরসা রোদের জন্য প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হই,
অথচ অমাবস্যা নিজস্ব প্রতাপের প্রদর্শনী কায়েম
রেখেছে আলোর গর্দান ধরে বহুদূরে ঠেলে দিয়ে। ভীত
আমি কখনও সখনও মাথা ঝাঁকিয়ে হয়ে উঠি প্রতিবাদী।ধুলোর সন্ত্রাসে অচেতন আবর্জনা স্তূপের নীচে করুণ
সমাহিত-প্রায় আমি প্রগাঢ় জ্বলজ্বলে এক কণ্ঠস্বরের
স্পর্শে, কে যেন বলছেন, ‘জেগে ওঠো কবি মায়াবী ঘুমের
জাল ছিঁড়ে, দ্যাখো চেয়ে কী প্রতীক্ষা করছে তোমাকে
অভিবাদন জানাবার আকাঙ্ক্ষায়। দেখি, অদূরে
নদীতীরে একটি সোনার তরী দুলছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
এবং মাস্তুলে-গাঁথা পতাকা অপরূপ নর্তকীর মত
নৃত্যপর আর মহাকাশে ধ্বনিত বাংলার জয়গান। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | গোলাপ পায়রা আর প্রজাপতিদের ভিড়ে ছিলে
তুমি সোমবার সুখী, এবং মঙ্গলবার ঘাসে
শুয়েছিলে একাকিনী পুরাতন কবরের পাশে,
বুধবার, কী আশ্চর্য, বহুদূরে আকাশের নীলে
তোমার দোলনা দুলছিলো; তুমি আর আমি মিলে
কটেজে খেয়েছি চুমো বারংবার বৃহস্পতিবার।
শুক্রবার দেখেছি তোমার চোখ, শ্রোণী, স্তনভার
স্তব্ধ ব্যাঙ্ক-কারিডরে, শনিবার হাঁসময় ঝিলে।রবিবার? তোমার সান্নিধ্য, হায় যায় বনবাসে
রবিবারে বারে বারে। তবে কি দেখি না প্রিয়তনা
তোমাকে তখন? রাজহাঁসের মতন স্পীডবোটে
তুমি, হল্দে-কালো শাড়ি-পরা; দেখি, চুল সুবাতাসে
ওড়ে কী উদ্দাম, মাছের ঝিলিক মনে হয় জমা;
সত্তাতটে নিয়ত তোমার দীপ্র উপস্থিতি ফোটে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।
সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।
জ্যোত্স্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,
তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোত্স্না আমার’
কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।
মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে
যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?
তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’। |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাডায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নডছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাডির এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে –
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এখন মাঝরাস্তায় আমি; শ্বাসরোধকারী নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালীতে,
বুকে, ঊরুতে আর
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠছে আমার চারপাশে।অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। মনে হয়,
এখানে কোথাও তুমি আছো, ডাকলেই
সাড়া দেবে লহমায়। তলোয়ার মাছের মতো
তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি, আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আ কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখবো বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা আর
ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।এখানে কোথাও না কোথাও তুমি আছো,
এই বিশ্বাস কখনও-সখনও
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাশা-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করবো যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে?জ্ঞান আমার উদ্ধার, তারই অন্বেষণে
উজিয়ে চলি
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার। এজন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে যাবো
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমার কাটে না দিন, কাটে না যে রাত, প্রিয়তমা,
তোমার বিহনে আর। আকাশের মেঘ,
গাছের পাতায় রোদে, অন্ধকারে, পূর্ণিমায়, শ্রাবণ
ধারায়,
নির্দয় খরায়, ঝিলে, পাখির স্বপ্নিল চোখে, রুক্ষ
পাথরে, ঝর্ণায় আর হরিণের চিত্রল শরীরে
তোমাকেই খুঁজি নিশিদিন। বস্তুত তোমারই শুদ্ধ ধ্যানে
রোজ
বেলা ব’য়ে যায়
আমাকে ক্ষতার্ত ক’রে। ব’সে থাকি অসহায়, একা।কখনো যখন কবিতার খাতা খুলে বসি অতি
সঙ্গোপনে, তুমি অক্ষরের
অনিন্দ্য প্রতিমা হ’য়ে দাঁড়াও পাতায়। তোমাকেই
সারাক্ষণ দেখার আশায় থাকি এই
বিরূপ শহরে পায়ে ফোস্কা নিয়ে, ধূসর মাথায়
কাঁটার মুকুট প’রে। তবু যদি তুমি
বোধাতীত অভিমানে, ক্ষোভে নিজে খুব
দগ্ধ হয়ে আমাকে পোড়াও, তবে আমি
অনিন্দ্রপীড়িত এই মাথা কার জানু কিংবা বুকে
রেখে স্নিগ্ধ বাগানের ঘ্রাণ পাবো, বলো?প্রিয়তমা, হয়ো না বিমুখ, একবার
এসে দেখে যাও আজ তোমার ইস্কের আতশের
কুণ্ডলীতে আমার যা হাল,
একেই তো সুফীরা বলেন জানি ফানা হ’য়ে যাওয়া। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এই তো আমার নাতি হাঁটি হাঁটি পা পা করে পার
করে দিলো তিনটি বছর। এখনো অক্ষরজ্ঞান তার
হয়নি সঠিক। অবশ্য সে মাঝে-মাঝে আওড়ায়
অ-আ-ক-খম এ-বি সি-ডি, মাতে ছেলেভোলানো ছড়ায়
মায়ের, খালার সঙ্গে। নানা রঙের বই নিয়ে
কখনো সখানো বসে, পড়ে আস্তে ইনিয়-বিনিয়ে,
যেন সে পড় য়া মস্ত। কখনো আমার খুব পুরু
লেন্সের চশমা পরে আর তাকায় টোলের গুরু
মশায়ের ঢঙে। তবে তার বড় বেশি পক্ষপাত
রঙিন ছবির প্রতি। গালিভার, সিন্দাবাদ, সাত
সমুদ্দর তেরো নদী, সিংহ এবং রাক্ষুসে বাঘ,
গণ্ডার, তালুক, বুনো হাতি, উটের পায়ের দাগ
বালিতে দেখতে ভালোবাসে। যখন টিভিতে বন
জঙ্গলের ছবি দ্যাখে, তখন সে খুশিতে কেমন
ডগমগে হয়ে ওঠে। হঠাৎ বায়না ধরে জঙ্গলে যাবার
ঝুলিয়ে বন্দক কাঁধে, যেন আজই করবে সাবাড়
হিংস্র পশুদের, ঘোরে যারা জঙ্গলের আনাচে কানাচে।
কী করে বোঝাই তাকে বস্তুত সে জঙ্গলেই আছে? (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা,
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল,
স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক,
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়া তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্ত জোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক,
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন,
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতে নম্র পাতায় মেহেদির রঙ।
স্বাধীনতা তুমি
বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালোচুলে,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা। |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | কবেকার ঘাসঢাকা এক টুকরো জমি, ঝোপঝাড়ের
খাসমহল, ঝকমকে আকাশ
অদৃশ্য ঘরের বারান্দা, অন্তরালবর্তিনী
মায়ের তাকিয়ে-থাকা
ইতিহাসের কোনো ইশারা দেখেনি। সকালবেলার হাওয়া
অবিন্যস্ত করেনি তার চুল। তার দৃষ্টি ছিল
সামনের দিকে, ভোরকে সে সোদরপ্রতিম ভেবেছিল?
বলতে পারব না, আমি বলতে পারব না।
তার উপর দিয়ে ঢেউয়ের মতো গড়িয়ে গেছে
বছরের পর বছর। একটি দোয়েল,
আকাশের সবচেয়ে দূরবর্তী নক্ষত্র, নদী, অমাবস্যা,
জোনাকিপুঞ্জ আর রৌদ্রদগ্ধ রাজপথ
তাকে চিহ্নিত করেছিল ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ হিসেবে,
সে জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি কোনোদিন।সে কি কখনও রাত জেগে কাউকে লিখেছিল চিঠি
অনুরাগের অক্ষর সাজিয়ে? দিঘির জলে পা ডুবিয়ে
তার বিকেল কি সন্ধ্যায় ঢলে পড়েছে
হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বাড়ানো প্রতীক্ষায়? সে কি রাজনৈতিক
ইস্তাহার পড়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? তার নাম কি
লেখা ছিল পুলিশের স্থুলোদর খাতায়?
জানালার দিকে ঝুঁকে-থাকা
গাছটিকে প্রশ্ন ক’রে ক’রে ক্লান্ত হ’লেও জানতে পারব না।ভর সন্ধেবেলা বরকতের পুরোনো এক ফটোগ্রাফ
আমার হাতে এসে যাবে, ভাবিনি। তার মায়ের
যত্নের আশ্রয় ছেড়ে সেটি এখন
আমার হাতের উষ্ণতায়। সহজে চোখ ফেরানো
যায় না, যদি বলি, বিস্ময়ের ঘোর নয়,
কোনো চমৎকারিত্ব নয়,
কোনোরকম রোমঞ্চও নয়, শুধু ইতিহাসের একটি অধ্যায়
আমার দৃষ্টি থেকে ছুটে নীলিমায় মিশে গেল,
তবে কি মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেবো আমি?
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে,
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে,
ঘাস-ঢাকা মাটিতে ফুল ঝরে।
সুদূরতম এক নক্ষত্র আকাশ থেকে ছুটে এসে
চুমো খেতে চায় ঘাস-ঢাকা, ফুল-মাখা মাটিকে।চমৎকার একটি গল্প বানানো যায় ফটোগ্রাফের
বরকতকে কেন্দ্রবিন্দু ক’রে
মিডলক্লাশ সেন্টিমেন্টের ভিয়েন দিয়ে।
একুশে ফেব্রুয়ারির শপথ, শপথ এই
ফাল্গুনের গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশের,আমি সে রকম কিছুই করব না।
সূর্যোদয়ের মতো পবিত্রতাকে মেঘাচ্ছন্ন করার,
অক্ষরের প্রগলভতায় কুয়াশাচ্ছন্ন করার অধিকার
কেউ আমাকে দেয়নি।
‘এই ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে
নীরব থাকো, সময় হোক পরিপক্ক ফল, সন্তের ধ্যান’,
বলল আমাকে সন্ধেবেলার মুহূর্তগুলো।নকশা ঘেরা কাচবন্দী বরকতার পুরোনো ফটোগ্রাফ
সময়ের ছুটন্ত খুর থেকে ঝরে-পড়া ধুলোয় বিবর্ণ,
অথচ আমার মনে হলো, সেই ছবির
ভেতর থেকে জ্যোতিকণাগুলো
চক্রাকারে বেরুতে বেরুতে নিমেষে
ছড়িয়ে পড়ল সব খানে। শপথ বর্ণমালার,
কী ক’রে ভর সন্ধেবেলা আমার চতুর্দিকে
আলোর সমুদ্র, আমি বলতে পারব না। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ব্যাপক সংকটে পথ কোথায়?
শক্রঘেরা ব্যুহে মিত্র খুঁজি।
ব্যর্থ সন্ধানে আমারও হায়
ফুরায় ক্রমাগত আয়ুর পুঁজি।
অগ্রজের কৃতকর্ম যত
প্রেতের মতো নাচে অবচেতনে।
অচিন সত্তায় প্রাচীন ক্ষত,
ঊর্ণনাভ ঘোরে বিবশ মনে।যায় যে যৌবন অস্তাচলে,
জীবন হিমায়িত শুকনো ডাল;
অথচ সেখানেও হঠাৎ জ্বলে
বিরল উৎসবে শিমুল-লাল।নিষেধ চারদিকে তুলছে ফণা,
শুকনো ডাল থেকে উধাও পাখি।
বিলাপে জমে আসে রক্তকণা,
হৃদয়ে হাহাকার, একাকী থাকি।বজ্রপাতে পোড়া গাছের কাছে
সবুজ পাতা চাওয়া নিরর্থক।
সেখানে অঙ্গার, ভস্ম আছে
এবং স্বপ্নের দগ্ধ ত্বক।স্বপ্ন আনে প্রাণে ক্ষণিক দ্যুতি,
লগ্ন তাই আজো প্রতীক্ষায়।
ভোগায় দিনরাত যে-বিচ্যুতি,
তাকেই শোধরাই তিরিক্ষায়।
কিন্তু থেকে যায় ক্রটির ছাপ
এখনো নন্দিত জল্পনায়।
কেবলি বেড়ে যায় মনস্তাপ,
তোমাকে খুঁজে ফিরি কল্পনায়।বিস্ফোরণ আমি শুনবো বলে
সবার মতো আজ পেতেছি কান
শ্মশানে কিংশুক ফোটাতে হলে
জরুরি অন্তত আত্মদান। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমি কি খাইনি ভোরে এবং দুপুরে নীলিমার
রুটি আর খাইনি কি পেট পুরে নক্ষত্রের ভাত
চন্দিমার ঝোল দিয়ে? আঁধারের পুরনো মদিরা
করিনি আকণ্ঠ পান? কখনো চাঁদের নাও কাঁধে
বয়ে পথ চলি, কখনোবা সুরুজের খব কাছে
গিয়ে দগ্ধ হয়ে যাই আপাদমস্তক। সামুদ্রিক
হাঙরের সঙ্গে যুঝে রক্তাক্ত শরীরে খুঁজে পাই
একটি প্রবাল-দ্বীপ, যা চকিতে শূন্যে মিশে যায়।তান্ত্রিকের মতো ক্ষণে ক্ষণে করি মন্ত্র উচ্চারণ
গহন অরণ্যে কিংবা পর্বত চূড়ায় মগ্নতায়
এবং সুফীর মতো নাচি জিকিরের ছন্দে আজো
সারারাত। এই সবকিছু কবিতারই জন্যে, জানি;
প্রেমিকা ও কবিতায় মানি না প্রভেদ। প্রিয়তমা
এখন অধরা নয়, দেবে নাকি ধরা প্রকৃত কবিতা? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | নীতিমূলক | এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।
মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?
নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার আস্তিনে আমি লুকিয়ে রাখিনি কোনো ছুরি,
কোমরে রিভলবার নেই অথবা শিশিতে বিষ
নেই এক ফোঁটা, নেই হাতে বাঘ্নখ কিংবা শিস
দিতে দিতে কাউকেও আস্তে সুস্থে কাস্তে কি হাতুড়ি
দিয়ে ফৌত করিনি কখনো কিংবা ছলনা চাতুরী
মূলধন ক’রে কোনো শক্রূকেও বলির মহিষ
বানাইনি, কস্মিনকালেও আমি করিনি কুর্নিশ
স্বৈরাচারী লৌহ মানবকে অন্তরালে। লুকোচুরিখেলেছি বরংমরণের সঙ্গে ভীষণ একাকী।
আমার আড়ালে আমি নিজেই কী নগ্ন, অসহায়
এক খয়া খর্বুটে মানুষ, কিন্তু সর্বদাই কাঁধে
নিঃসঙ্গ বেড়াই বয়ে কায়ক্লেশে সুপ্রাচীন দায়।
পেশী শ্লথ হয়, চোখ বুজে আসে কালো অবসাদে,
ঘুমের ভেতরে ক্রূর গান গায় স্বপ্নচর পাখি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | (আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রীতিভাজনেষু)আমার পিতামহের আমলের অনেক পুরনো
এক সিন্দুকের কথা জানি, যার ডালা
খুললেই চকিতে প্রাচীনতা
বিশীর্ণ আঙুল নেড়ে নেড়ে ডাকে রহস্যের স্বরে।
যেন তার অভ্যন্তরে খুব দীর্ঘ পথ আছে গাছগাছালির
সেরেনাদে খুব স্নিগ্ধ, চোখের পাতায় জমে ছায়া,
আছে কিছু তসরের শাড়ির সৌরভ,
ঘাসে ফেলে-যাওয়া কারো পশমের চটি,
সৌন্দর্যমাতাল রুগ্ন খর্বুটে কবির এপিটাফ,
বাছুরের ঘুণ্টি-বাঁধা মেটে গলা, দাদার তসবিহ্-
এরকম ভাষাচর্চা করে সে সিন্দুক।
এখন সে কথা থাক।সাতটি সোনালি মাছ আলোকিত কড়িকাঠ থেকে
নেমে পিয়ানোর রিডে নাচে,
আয়না বেয়ে উদ্বেড়ালের নাকের ডগার নিচে
ব্যালেরিনাদের মতো মোহন বিন্যাস তৈরি করে,
তারপর ঘর ছেড়ে উড়ে যায় দূরে
জানালার পর্দা দুলিয়ে
কুঁড়েঘর, টিনশেড ছুঁয়ে গায়ে মেখে
মেঘেদের রোঁয়া।
পাহাড়ি ঈগল সেই দৃশ্যের চকিত উন্মীলনে
ঈষৎ বিস্মিত হয়ে রহস্যের মর্মমূল স্পর্শ করে
নিজেও সঙ্গীতময় হয়।
সোনালি মাছের গান এখানেই লয়ে নিবিড় মিলিয়ে যাক।প্রাচীন দুর্গের মতো একটি বাড়ির কাছে যাই
মাঝে-মধ্যে,দাঁড়াই সামান্যক্ষণ, এদিক-ওদিক লক্ষ করি,
দূর থেকে জেনে নিতে চাই
বাড়ির ভেতর কতটুকু অন্ধকার কিংবা কতটা আবির
তৈরি হয়। কখনও সে বাড়ি আশাবরী ধরে,
কখনও-বা গায় মধ্যরাতে
দরবারি কানাড়া। একজন থাকে সে বাড়িতে, যাকে
কখনও দেখিনি আমি, যার নরম পায়ের কাছে
শুয়ে থাকে এক জোড়া চিতাবাঘ, কতিপয় নীলাভ ময়ূর
ঘোরে সারাক্ষণ আশেপাশে; মাঝে-মাঝে
তার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে ঝাড়লণ্ঠনের মতো,
সে-ভাষা বুঝি না।
আজ থাকে, সে-বাড়ির কথা
একান্ত বিশদভাবে বলা যাবে কখনও আবার।(হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কারো দণ্ডে দেশান্তরী হইনি, তবুও মনে হয়
সর্বক্ষণ নির্বাসনে আছি। কোথাও দেখি না কোনো
চেনা মুখ; যাদের কাছের লোক বলে জানতাম
এতকাল, তারাও কেমন অচেনার আবরণে
উপস্থিত হয় পথে। এখন ব্যাপক অগ্নিঝড়
পাড়ায় পাড়ায়, কী সহজে দিনের আলোয় দিব্যি
খুন হয় আদম-সন্তান আর রক্ষক ভক্ষক
হয়ে যায় মসনদে খুব জেঁকে বসবার মোহে।এরকম ডামাডোলে, উৎপীড়নে, ধোঁয়ায়, লাঠির,
বন্দুকের কর্কশ চিৎকারে ত্রস্ত দিনরাত এই
কসাইখানাকে আজ কী করে স্বদেশ বলে ভাবি?
প্রিয়তমা, এখন তুমিও নেই এ শহরে, সব
স্থানে অমাবস্যা ছেয়ে আছে, এই দিশেহারা কবি
নির্বাসিত জনের বেদনা বয়ে একা, জীবন্মৃত। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | খুব ফিকে গাঁদা রঙের বিকেল। চোখ চোলা,
মন ডুবুরীর আঁটো পোশাক পরেছে
নিরিবিলি; আমাকে কি মানায় এখন জেগে
স্বপ্ন দেখা? দেখি অকস্মাৎ ঘরে এসে, হে নবীনা,
তুমি একগুচ্ছ ফুল তুলে দিতে হাতে
ঋজু স্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ ছিলে বসে
দূরে টুকরো টাকরা কথা, আমার গতায়ু
যৌবনের শুশ্রুষায় নিজেকে নিয়োগ
করেছিলে বুঝি, নয়তো কী ক’রে আবার
আমার ভেতর যুবা বয়সের দিনগুলি
আড়মোড়া ভাঙে? কখন যে বাড়াই তোমার দিকে হাত,
শুধু রিক্ত পাঁচটি আঙুল স্পর্শ করে শূন্যতাকে।তুমি চ’লে যাবার পরেও বসে থাকো
সম্মুখ চেয়ারে
আমার মুখস্থ-করা সেই ভঙ্গিমায়। হেঁটে যাই
তোমার ভেতর দিয়ে স্বপ্নচারিতায়
কোনো এক বেনামি নগরে। কেউ দেখে না, শোনে না
কিছু, শুধু নিজে জানি, তুমিহীনতায়
তুমি থাকো পবিত্র সৌরভ হয়ে এবং তোমার করতলে
লোর্কার কমলালেবু, ঠোঁটে নেরুদার প্রজাপতি।আমার পাঁজর ফুঁড়ে রক্তের ফোয়ারা টেবিলের
গোলাপকে আরো বেশি লাল ক’রে তোলে আর দেয়ালের সাদা
থেকে পেরেকের ক্ষতচিহ্নসহ
নিঃশব্দে ওঠেন জেগে যীশু,
তর্জনী উচিয়ে
আমাকে দেখিয়ে দেন ক্রূশকাঠ, উচ্চারিত হয়
‘বও, বয়ে যাও তুমি বিরামবিহীন। গলগোথা
গন্ধে ভরে যায় ঘর, লাল জোব্বা, হায়,
প’ড়ে আছে পুরোনো মেঝেতে, বুড়ো সুড়ো
কারো খুব কুষ্ণিত ললাটরেখা, কে এক নারীর
দু’গালে গড়িয়ে পড়ে কী করুণ পানি; কারা যেন
জুয়ো খেলে চ’লে গেছে, দিব্যকান্তি গাঁথা ক্রূশকাঠে।কখনো তোমাকে শুনি, শোনাই তোমাকে
কখনো-বা, তোমার মধুর কণ্ঠস্বরে মুছে যায়
আমার অতীত আর তোমার নীরব ফুলগুলি
কী বাঙ্ময় ঝুঁকে থাকে আমার উদ্দেশে। তোমারও কি
এমন ধরন? কিছুকাল
পরে কথাচ্ছলে প্রশ্ন করি, ‘সেদিন বিকেলবেলা
এসেছিলে নাকি? স্মিত ঠোঁটে
বললে তুমি, ‘কই, না তো। কে খবর দিলো মিছেমিছি?’
বেজে ওঠে যেন স্যাল্ডেলিয়ার কোথাও
এবং তোমাকে ঘিরে থাকে গীতবিতানের বিভিন্ন মুর্চ্ছনা। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | তুমিতো এসেই বললে, এখন আমাকে যেতে হবে।
সরে না আমার মুখে কথা, শুধু আর্ত মনে ভাবি-
পুষ্পাকুল বসন্তের কাছে শ্রান্ত হেমন্তের দাবি
কতটুকু? তোমার উপস্থিতির সুস্মিত বিভবে
আমার যে একরত্তি অধিকার নেই, জেনেছি তা
অনেক আগেই, জানি নিশ্চিত তোমাকে অবশেষে
যেতে দিতে হবে, হবে ছেড়ে দিতে শীঘ্র ম্লান হেসে,
তবু জ্বেলে বসে আছি সত্তাময় লেলিহান চিতা।বীতপুষ্প যে বাগান ছিলো পড়ে এক কোণে, যার
হৃতস্বাস্থ্য শুক্নো ডালে কোনো পাখি বহুকাল গান
গায়নি তন্ময়, তাকে পুনরায় বসন্ত-বিহ্বল
করেছো সে কোন্ খামখেয়ালে হে প্রতিমা আমার?
মিলন মুহূর্ত শুরু না হতেই দৃশ্যাবলি করে ছল ছল,
বিচ্ছেদ সকলই স্তদ্ধ, কেবল হৃদয় স্পন্দমান। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে,
ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে
প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়;
ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে যে উঠে আসে
রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।
ধন্য সেই পুরুষ কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে
ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসে
আর তোমারই প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ
জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহংকারের মতো
ফুটে আছে রক্তজবা, আর
আমরা সেই পুষ্পের দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের
চোখের পলক পড়তে চায়না,
অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।
দেখ, একে একে, সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত
মোহিনী নর্তকীর মতো
জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,
বিশ্বাস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে
সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন
কুমোরের ভাঙা পাত্রের মতো,
চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,
দেখ, যে কোন ফলের গাছ
সময়ে-অসময়ে ভরে উঠছে শুধু মাকাল ফলে।
ঝলসে-যাওয়া গাসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা
দেখ, এখানে আজ
কাক আর কোকিলের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
নানা ছল ছুতোয়
স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেব্বাজের দল।
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
তোমাকে হারিয়ে
আমরা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো
হয়ে যাচ্ছিলাম,
আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে,
তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে
আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে বাধিত
করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে
রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্ততিগানে। কেননা জেনেছি
জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল, গান হয়ে
নেমে অসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয়না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয়
জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের উপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তোযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | এক শহরেই থাকি আমরা দু’জন, গৌরী আর
আমি, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে দেখা করতে পারি না
আজকাল; এ কেমন কাল এলো? লুট, হত্যা বিনা
যায় না একটি দিনও। জালিমের কর্কশ হুঙ্কার
ত্রাস সৃষ্টি করে চতুর্দিকে, কোনোদিকে বেরুবার
তেমন সুবিধে নেই। সরকার শ্বাপদ হলে, কেউ
নিলে কিছু, সন্ত্রাসীর বাড়লে দাপট, তবে কেউ
নিরাপদ নয় প্রেমও হয় মুখোমুখি হায়নার।এখন গৌরীর মুখ দেখি কল্পনায়, বয়ে চলি
প্রতিদিন বিচ্ছেদের ভার; গৌরী আর রাজপথে
লেগে-থাকা রক্তচিহ্ন স্পষ্ট পাশাপাশি, অন্ধ গলি
মনে হয় এ জীবন। একা-একা মানস-সৈকতে
হাঁটি, শুই; ভাবি, এ বিচ্ছেদ এমন দুঃসহ এই
মুহূর্তে মৃত্যুতে চির বিচ্ছেদের যন্ত্রণাই নেই। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | নির্ঘুম বসে ছিলাম একলা ঘরে,
হাত-ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। বাইরে
অন্ধকার আদিম জন্তুর মতো মাথা গুঁজে জমিনে
ঘুমিয়ে আছে। অকস্মাৎ সেই জন্তু
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে প্রসারিত ক’রে
ওর দাঁত-নখে কামড়ে ধরলো ঘুমন্ত শহরকে। কেঁপে
উঠলো চেয়ার, আমার লেখার টেবিল। ভূমিকম্প ভেবে
বাইরে ছুটে গিয়ে
চেয়ারেই আটকে থাকলাম, যেন কেউ আমাকে
আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে আমার চিরচেনা আসনে।সেই মুহূর্তে, পরদিন প্রচারিত হলো লোকমুখে,-
সংবাদপত্রের পাতায়-আমার এই
জন্মশহরের ঐতিহ্যখচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীনিবাসে রাত তিনটায় চলছিল হায়েনাদের তাণ্ডব,
নিদ্রাছুট ছাত্রীগণ পথ পাচ্ছিল না আত্মারক্ষার। আব্রু
হারানোর শঙ্কায় লুকোতে গিয়েও
ওদের অঙ্গবাসে পড়লো টান, আলুলায়িত বেণী,
খসে-পড়া খোঁপা পোশাক সজ্জিত জান্তব সন্ত্রাসে হলো লাঞ্ছিত।সেই মুহূর্তে আশপাশের গাছপালা শাসন-না-মানা ক্রোধে
কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যেতে চেয়েছিল
ছাত্রীনিবাসে, কিন্তু, হায়, ওদের শেকড় বন্দী কঠোর মাটিতে।
সেই মুহূর্তে শান্ত বুড়িগঙ্গা নদী ধিক্কারে ফুঁসে
উঠছিল খুব, অথচ বড় নাচার সেই জলধারা
তটে মাথা কুটেও পারলো না
ছুটে গিয়ে জালিমদের ভাসিয়ে
নিয়ে যেতে। নাগরিকগণ তখন ঘুমে অচেতন।এ কেমন দূষিত, পচন-ধরা কালে নিঃশ্বাস নিচ্ছি? আমরা
সবাই কি ঠুঁটো জগন্নাথ হ’য়ে বসে থাকবো অষ্টপ্রহর?
আমরা কি আহারান্তে পান চিবিয়ে,
সিগারেট ফুঁকে, আড্ডায় গা ভাসিয়ে কাটিয়ে
দেবো সময়? আমরা কি ঘুমিয়ে থাকবো কালবেলায়?
আমরা কি আমাদের ভগ্নি কন্যাদের
বস্ত্রহরণ পর্বে নির্লজ্জের মতো নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থাকবো?
আমরা কি তখনও ফেটে পড়বো না বিস্ফোরণে?পাড়ায় পাড়ায় কখন কত কী-যে হারায়,
অনেকেই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে। তুমি কি তোমার
ভাঙা গালে হাত দিয়ে ব’সে ভাবতে থাকবে কারা কোথায়
কী লুটে নিলো, কারাই বা হলো বঞ্চিত? ভাবনারা
মৌমাছি হয়ে হুল ফোটাবে তোমার অস্তিত্বে,
তুমি ধৈর্য ধরে সইবে, সবই সইতে থাকবে
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তা হবে না, চলতে দেবো না
সেই খেলা ব’লে গর্জে উঠবে তারুণ্য, আগামীর নকিব।এই জাঁহাবাজ, দাঁত-নখ-খিচোনো অমাবস্যার
আস্ফালন আমরা কি থামাতে পারবো না?
আমরা কি পারবো না ভয়ঙ্কর কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমা-চাঁদের পথ
সুগম ক’রে দিতে আমাদের
প্রতিবাদের ঝড়ে ঝেঁটিয়ে সকল বাধা? আমরা কি
পারবো না জন্ম দিতে তেমন নতুন যুগকে,
যে-কালে ছদ্মবেশী স্বৈর শাসকের হুঙ্কারে,
অঙ্গুলি হেলনে আজ্ঞাবহ বরকন্দাজদের তাণ্ডবে
ধুলোয় লুটোবে না মানবিক মূল্যবোধ, হিংস্র কাদায়
সমাহিত হবে না অগ্রসর তরুণ তরুণীর স্বপ্ন, আর্তনাদ করবে না সভ্যতা? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | রঞ্জিতা তোমার নাম, এতকাল পরেও কেমন
নির্ভুল মসৃণ মনে পড়ে যায় বেলা-অবেলায়।
রঞ্জিতা তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোনো কে
গ্রীষ্মের দুপুরে দীপ্র কবি সম্মেলনে
কলকাতায় ন’বছর আগে, মনে পড়ে?সহজ সৌন্দর্যে তুমি এসে বসলে আমার পাশে।
কবি প্রসিদ্ধির
অমেয় ভাণ্ডার থেকে রত্নরাজি নিয়ে
আজ আর সাজাব না তোমাকে রঞ্জিতা। শুধু বলি,
তোমার চোখের মতো অমন সুন্দর চোখ কখনো দেখিনি। ‘বিচ্ছিরি গরম’
বলেই সুনীল খাতা দুলিয়ে আমাকে তুমি হাওয়া
দিতে শুরু করেছিলে, সেই হাওয়া একরাশ নক্ষত্রের মতো
মমতা ছড়িয়ে দ্যায়। যদি আমি রামেন্দ্র সুন্দর
ত্রিবেদী হতাম, তবে বলতাম হে মেয়ে ‘ইহাই বাঙালিত্ব’।কিছুই বলেনি একালের কবি, শুধু মুগ্ধাবেশে
দেখেছে তোমার মধ্যে তন্বী গাছ, পালতোলা নৌকো,
পদ্মময় দীঘি আর শহরের নিবিড় উৎসব।
রঞ্জিতা সান্নিধ্য বড় বেশি মোহময় চিত্রকল্প তৈরি করে,
দেখায় স্বপ্নের গ্রীবা-বুঝি তাই আমিও ভেবেছি,
ক’দিনের সান্নিধ্যের সুরা পান করে,
একান্ত আমারই দিকে বয়েছিল তোমার গোলাপি হৃদয়ের
মদির নিঃশ্বাস আর সে বিশ্বাসে আমরা দু’জন
অপরাহ্নে পাশাপাশি হেঁটে গেছি কলেজ স্ট্রিটের
অলৌকিক ভিড়ে, ফুটপাথে ফুটেছিল মল্লিকা, টগর, জুঁই
তোমার হৃদয়ে উন্মীলিত
আমারই কবিতা আর চোখের পাতায় শতকের অস্তরাগ।
বঞ্জিতা আবার কবে দেখা হবে আমাদের কোন
বিকেল বেলার কনে-দেখা আলোর মায়ায়, কোন
সে কবি সভায় কিংবা ফুটপাতে?
রঞ্জিতা তোমাকে আমি ডেকেছি ব্যাকুল বারংবারডেকেছি আমার।
নিজস্ব বিবরে। এই চরাচরব্যাপী অসম্ভব হট্ররোলে
অসহায় আমার এ কণ্ঠস্বর কি যাবে না ডুবে?
কী করে আমরা ফের হবো মুখোমুখি
বিচ্ছন্নতাবোধের পাতালে?
ছদ্মবেশী নানাদেশী ঘাতকের খড়্গের ছায়ায়
কী করে আমরা চুমো খাব?
কী করে হাঁটব আণবিক আবর্জনাময় পথে?
ভীষণ গোলকধাঁধা রাজনীতি, আমরা হারিয়ে ফেলি পথ
বার বার, পড়ি খানাখন্দে, মতবাদের সাঁড়াশি
হঠাৎ উপড়ে ফেলে আমাদের প্রত্যেকের একেকটি চোখ। যে ভূখণ্ডে
রঞ্জিতা তোমার আদিবাস, তার মাৎস্যন্যায় দু’চোখের বিষ
এবং আমার মধ্যে নেই কোনো বশংবদ ছায়া।হয়তো কখনো আর কলকাতায় যাব না এবং
তুমিও ঢাকায় আসবে না। তাহলে কোথায় বলো
দেখা হবে আমাদের পুনরায় অচেনা পথের কোন মোড়ে?
মস্কো কি পিকিং-এ নয়, ওয়াশিংটনেও নয়, ব্যাঙ্কক জাকার্তা
জেদ্দা কি ইস্তামবুল, হামবুর্গ, কোনোখানে নয়।
আমরা দু’জন
হয়তো মিলিত হবো নামগোত্রহীন
উজ্জ্বল রাজধানীতে কোনো, যাকে ডাকব আমরা
মানবতা বলে,
যেমন আনন্দে নবজাতককে ডাকে তার জনক-জননী। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কেন তুমি অভিমানে এমন বিষণ্ন আলা ছড়াও আমাকে
ম্লান করে যখন তখন?
কেন যে সরিয়ে নাও হাত নানা ছলে,
বুঝি না কিছুই।
এরকম দৃষ্টি দাও যদি, তাহলে আমার সত্তা জমে
নিথর পাথর হ’য়ে যাবে, মগজ বেবাক খড়ে
যাবে ভরে, আমি শুধু দম দেয়া পুতুলের মতো
একাকী ঘুরবো দিগ্ধিদিক।তোমার চুম্বন থেকে, আলিঙ্গন থেকে বহুদূরে
পড়ে আছি একা শ্বাসকষ্ট হয় রাত্রিদিন, তুমি
অন্যত্র তোমার
সৌন্দর্যের শিখা জ্বেলে আছো
আমার কষ্টের প্রতি উদাসীন।
আমার বিরূদ্ধে আজ একে একে সকলেই গেছে-
আমার বিরূদ্ধে
পাখিরা নিয়েছে নিন্দা প্রস্তাব, নক্ষত্র
প্রতিবাদ মুখর এবং
শহর ব্যানারে তার লিখেছে বিশাল লাল সুস্পষ্ট অক্ষরে,
‘নির্বাসনে যাও’।
আমার নিজেরই ঘর হয়ে যায় জ্বলন্ত কবর,
এমন কি হাওয়া আজ প্রহরে প্রহরে
শক্রতা সাধছে শুধু জাগিয়ে তোমার স্মৃতিমালা,
নিভিয়ে স্বপ্নের দীপাবলী।
আমার নিকট থেকে তুমি সরে গেলে অভিমানে
একটি সভ্যতা অতি দ্রুত ভেঙে যাবে
আমার ভেতরে।
এই যে আমার যাত্রা, কখনো তা’ তোমাকে পেছনে
ফেলে নয়, তুমি চিরসঙ্গিনী আমার
পথে কি বিপথে, যেখানেই পড়ুক আমার পদচ্ছাপ।তোমার সমুখে নতজানু হয়ে বলি-
আমাকে পেছনে ফেলে তুচ্ছতার ভিড়ে
আমার নিকট থেকে দূরে
যেও না কখনো।
আমিতো তোমার ভেতরেই সারাক্ষণ সুখে-দুঃখে
দাঁড়িয়ে থাকতে চাই, হতে চাই গান স্তব্ধতায়,-
এই ইচ্ছা প্রতিটি ঋতুতে
প্রবল সজীব থাকে। যখন খুলবো চক্ষুদ্বয়,
তখন তোমারই দিকে পড়ে যেন চোখ। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | অনেক কাল আগেকার দিঘিটা নিঝুম ঘুমোচ্ছে, লাল
শাপলা ফুলদের স্বপ্নের নানা স্তরে
ভেসে-যাওয়া। পাশের ঘন পাতাময় গাছের
তন্দ্রাচ্ছন্নতা চিরে বেজে ওঠে দোয়েলের মেদুর শিস।
আড়মোড়া ভাঙে প্রাচীন দিঘি, শাপলা
ফুলগুলোর চোখে আঠা ধুয়ে যায় শিশিরে; গাছতলায়
গেরুয়া আলখাল্লা-পরা বাউল মেঘের দিকে
তাকিয়ে দোতারায় অলীক ভোরের সুর জাগায়।গ্রাম্যবধূ এদিক ওদিক তাকিয়ে যৌবনকে
দিঘির জলে ভাসায়। ভোরের টাটকা রোদ ওর ভেজা
যৌবনকে চুমোয় চুমোয় রক্তিম করে; বাউলের গান স্নানার্থিনীর
শরীরে পিছলে যেতে থাকে, খয়েরি বাছুর ঢুঁ মারে শাদা গাভীর ওলানে,
কৃশকায় চাষি লাঙল কাঁধে আলে হেঁটে যায়, দিঘির ধার ঘেঁষে
সাইকেল চালিয়ে মাঠে যাচ্ছেন এনজিও মহিলা কর্মী। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমি কি এভাবে বারবার
নিজের সঙ্গেই অভিনয় করে যাব?
এই যে এখন কালো পাখিটা আমার
মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, ওর
উড়াল আমার সর্বনাশ ডেকে আনবে কি আজ?দেখছি আমার হাত কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে,
খাতার পাতায় লেখা নয়া শব্দগুলো
কোন্ দুঃস্বপ্নের স্পর্শে কুষ্ঠরোগীর ক্ষতের মতো
হয়ে গেল? উড়ন্ত পাখির
চাঞ্চল্য কোথায় থেমে গেল?তাহ’লে আমি কি ক্রমান্বয়ে জবুথবু
মাংসপিণ্ড হয়ে এককোণে
প্রত্যহ থাকব প’ড়ে? যদি তাই হয়,
তা’হলে আমার বেঁচে থেকে
কী লাভ? কেবল জড়পিণ্ড হয়ে শুধু
ডান বাঁয়ে কিংবা সম্মুখে তাকিয়ে
দিনরাত কাটানো মাসের পর মাস,
বছরের পর ফের বছর কাটানো
নরক বাসের চেয়ে বেশি ছাড়া কিছু কম নয়।
কখনও চকিতে ভোরবেলা আমার ঘরের ঠিক
কাঁধ ঘেঁষে একটি সবুজ পাখি সৌন্দর্য বিলিয়ে
বসে থাকে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক
উৎসুক দৃষ্টির আভা ছড়িয়ে হঠাৎ পাখা মেলে
উড়ে চলে যায় দূরে অজানা কোথায়।বেলাশেষে জ্যোৎস্নাময় রাতে ওর কখনও হয় কি
সাধ উড়ে যেতে নক্ষত্রের
প্রোজ্জ্বল মেলায়? হয় না কি সাধ তার
চাঁদে গিয়ে বসতে কখনও? হয় না কি
সাধ তার ফোটাতে সুরের পুষ্পরাজি মায়ালোকে? (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | প্রণয়কৌতুকী তুই, ওরে যদি বলি সরাসরি,
ছিনালি স্বভাব তোর, সুনিশ্চিত জানি
হবে না সত্যের অপলাপ। একদা দুপুরে তুই,
সে তো আজ নয়, যৌবনের জ্বলজ্বলে
ফাল্গুনে আমার থরথর
পিপাসার্ত ওষ্ঠে দিয়েছিলি এঁকে প্রগাঢ় চুম্বন।অপরূপ আলিঙ্গনে সেই যে আমাকে বেঁধেছিলি,
অতীন্দ্রিয় সেই গাঢ় স্পর্শে করেছি ভ্রমণ দূর মেঘলোকে,
স্বর্গীয় হ্রদের তীরে শুয়ে
অচিন পাখির সখ্য, ঝুঁকে-পড়া নিরুপম গাছের পাতার
প্রাণঢালা মৃদু ছোঁয়া, নক্ষত্রের মদির চাউনি
পেয়ে গেছি বারবার, না চাইতে এখনও তো কিছু পেয়ে যাই।তবে কেন হৈ-হুল্লোড়ে মজে তুই এক ঝটকায়
বেচারা সর্বদা-অনুগত এই ক্ষমা প্রেমিকের
সান্নিধ্যের উষ্ণতা হেলায় ঠেলে দূরে চলে যাস
মাঝে মাঝে? অকুণ্ঠ কবুল করি, জীবিকার চাবুকের ঘায়ে
বিব্রত, রক্তাক্ত হই, তবুও তো ভুলিনি তোমায়, ওরে তোর
সত্তার অনিন্দ্য ঘ্রাণ, আজও চাই, তোকেই তো চাই মায়াবিনী।তোমার সন্ধ্যানে আজ চা-খানায়, অলিতে-গলিতে, পার্কে, মাঠে,
নদী তীরে হই না হাজির অসুস্থতা হেতু, তবে
গোপন আস্তানা আছে আমার হৃদয়
জুড়ে, যার আওতায় বেহেশ্ত-দোজখ,
দিঘির বুকের চাঁদ, তপ্ত রাজপথময় প্রতিবাদী দীপ্র
মিছিলের কলরব। তবুও কি ছেড়ে যাবে তোমার কবিকে? (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ইদানিং কখনও কখনও হঠাৎ কী-যে হয়,
আমার চোখের সামনে কিছু
ছবি ঝলসে ওঠে, যেগুলো বড় বেখাপ্পা, বেগানা।
সেসব ছবি আমাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে
বেশ কিছুক্ষণ। তখন আমার বেহুঁশ হওয়ার
উপক্রম। নিজেকে সামলে রাখি কোনও মতে।ক্ষণিক পরে নিজেকে দেখতে পাই একটি বাগানে।
বাগানের সৌন্দর্য এমনই, যা’
বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, শুধুউ অসামান্য
কোনও শিল্পী তার চিত্রে ফোটাতে সক্ষম
সেই সৃষ্টি। আমার বিস্ময় মুছে যাওয়ার
আগেই দেখি আমি পড়ে আছি এক হতশ্রী ভাগাড়ে।কে আমাকে মুক্তি দেবে এই ভয়ঙ্কর
পরিবেশ থেকে? আমি কি এখানে পচতে থাকবো?
অবিরাম বমি কি আমাকে বেহুঁশ করে ফেলবে?
দুশ্চিন্তায় অবসন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
একটি প্রফুল্ল সারস আমাকে তার ডানায়
আশ্রয় দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলো মেঘলোকে।কখন যে মেঘলোক থেকে অপরূপ এক উদ্যানে
এসে গাছতলায় ঠাঁই পেলাম,
টের পাইনি। নিজেকে কেমন পরিবর্তিত মনে হলো।
একি! আমার ভেতর এক পরিবর্তিত ব্যক্তিকে
অনুভব করি। অজানা কে যেন আড়াল থেকে
আমাকে কবির আভায় জ্বলজ্বল্ব করে! (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | নিজেই নিজের আচরণ নিশ্লেষণ করে খুব
বিস্মিত, বিপন্ন হয়ে যাই। আমার ভেতরকার
কোন্ অন্ধকার স্তর থেকে ক্ষিপ্ত এক জাগুয়ার
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। কখনো অতলে দিয়ে ডুব
আমি যেন জলজ সহিংস প্রাণী ছিঁড়ে খুঁড়ে
খাবো পাবো যা সমুখে, লেজের আঘাতে চতুর্দিক
তছনছ করে শেষে নিজেকেই ভয়ঙ্কর শিক
দিয়ে গেঁথে ভব্যতার খোলস ফেলবো ভেঙেচুরে।এই ভাঙচুর লক্ষ্য করে তুমি এর ব্যাখ্যা চেয়ে
আমাকে বৃথাই করো অপ্রস্তুত। কত ব্যাখ্যাতীত
বিষয় রয়েছে ভবে, অমীমাংসা যার অসহায়
করে রাখে মানুষকে, মাঝে মধ্যে অস্তিত্বের ভিত
ভয়ানক কেঁপে ওঠে। কালসন্ধ্যা নেমেছে, হে মেয়ে
ডোবাচ্ছো পীড়ন-গাঙে, আবার ভাসাও কিনারায়। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | মাঝে মাঝে মাটিতে বুক রাখি। আমার হৃৎস্পন্দন আর
মাটির বুকের টিপটিপ শব্দের যুগলবন্দি চলে অনেকক্ষণ।
মাটিলগ্ন হয়ে থাকবার এই আনন্দ উত্তাল ঢেউয়ের ওপর নৌকো।
আজ গুচ্ছ গুচ্ছ ঘাস ভেদ করে আমার বুক যখন মাটিতে পেতে
দিলাম, জমি আমাকে শোনাল দীর্ঘ পদধ্বনি। ক’জন লম্বা, শক্ত
সমর্থ, কান্তিমান পুরুষের পদযাত্রা আমার পাশ ঘেঁষে। আমি
অনন্য কোনও উৎসব-উদ্ভাসিত বালকের মতো তাঁদের শনাক্ত করি
আমার পূর্বপুরুষ বলে। তাঁরা আমার উদ্দেশে কোনও বাক্য
উচ্চারণ না করেই হিলহিলে শস্য ক্ষেতে প্রবেশ করলেন। শস্যের
কোরাসে মুগ্ধ আমি মাটিকে আরও বেশি বুকে বাঁধি। খানিক পরে
দেখি, আমার মৃতা জননী হেঁটে যেতে-যেতে আমার দিকে তাকালেন
অবর্ণনীয় স্নিগ্ধতায়। তাঁকে নির্বাক দেখে আমার কম্পিত ঠোঁট উচ্চারণ
করে, ‘মাগো, তুমি আমার সঙ্গে একটি বারও কি কথা বলবে না আর?
মার নিশ্চুপতা জায়গাটিকে অধিকতর নির্জনতা নীরবতা দান করে।
অসহায় আমি মাটিতে মুখ ঘষি, যেমন শৈশবে ঘষতাম মার বুকে।আমার ঢিপঢিপ বুক মাটিতে লগ্ন। হঠাৎ এ আমি কী অনুভব
করছি বুকের নিচে? প্রিয়তমা, এখন মনে হচ্ছে আমার বুকের নিচে
তোমার উদ্ভিন, স্ফুরিত স্তনদ্বয়। অথচ তুমি তো এখানে নেই কোথাও
এই মুহূর্তে। যখন তুমি ফিরে আসবে এই রুগ্ন আমার কাছে, হাসপাতালের
ফ্যাকাশে দেয়াল হয়ে উঠবে নববধূর গালের লালিমা। ফুটপাথ ফুঁড়ে
দেবশিশুর মতো দুলবে অজস্র ফুল। তোমার এই না-থাকা ক্রমাগত
কালো রঙ ছড়ায় আমার চিদাকাশে।মাটি মাতৃস্নেহে আমার বুকে স্বপ্ন-শস্য ফলায়, টেনে নিতে চায়
সোঁদা কোলের গভীরে। জমি নিজের বুকে চিরে আমার ঠোঁটের
কাছে এক হাত মুলিবাঁশ তুলে ধরে। মুলিবাঁশে ফুঁ দিই বেনামি
ব্যাকুলতায়। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে সুরজাল। আমি সুরবিহ্বল
নৃত্যমোহিত ময়ূর। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | মনে হয়, কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি কূলকিনারার
পাচ্ছি না সন্ধান, কাছে ধারে খড়কুটো তা-ও চোখে
পড়ছে না কিছতেই। এ কেমন ঘূর্ণি টেনে নিতে
চায় শুধু বুভুক্ষু অতলে? কে আমাকে ভুল পথে এনে
ফেলেছে এমন দুর্বিপাকে? সঙ্কট কখনো আসে
ভয়ঙ্কর রূপে, কখনোবা খুব মোহনীয় বেশে
অকস্মাৎ; আখেরে পরমা এল ভেবে অনুরাগে
ক্লান্ত গোধূলিতে কুহকিনীকেই করি আলিঙ্গন।ক্রূর কত জলজ প্রাণীর কোলাহলে সারাক্ষণ
হাবুডুবু খাচ্ছি, তবু সবাই নিষ্পৃহ অতিশয়;
এখন আমার দিকে এমন কি মায়াময়ী সে-ও
বাড়িয়ে দেয় না হাত। কী এক দহনে দগ্ধ হয়ে
নিজের প্রকৃত রূপ অন্তরালে রেখে প্রতিশোধ
নিচ্ছে আজ আমার ওপর নাকি নিজেরই উপর? (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | এতদিনে জেনে গেছি সুসময় ভীষণ অস্থির।
এখন তো বারংবার শবযাত্রা, কবরখানায়
একা একা ব’সে থাকা মৃত্যুগন্ধময় নিরালায়;
এখন পাবো না আর একটিও মুহূর্ত স্বস্তির।
ক্রূর অন্ধকারে আছি তুমিহীন অত্যন্ত একেলা।
কর্কশ গজায় দাড়ি, নখ বড়ো বেশি বেড়ে যায়,
গেন্থেও অমনোযোগী, প্রিয় বন্ধুবর্গের ডেরায়
প্রায়শ অনুপস্থিত আমি, দেখি মকরের খেলা।এ-খেলায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকি সকল সময়।
থামের আড়ালেও শক্রু চতুষ্পার্শ্বে জন্মান্ধ জল্লাদ,
কী করে বাঁচবো তবে? বেদনার্ত আমার হৃদয়।
জন্তুর বিষাক্ত দাঁতে বিদ্ধ, তবু হবো না উন্মাদ;
এখনো তো জীবনের প্রতি আমি কী দীপ্র উৎসুক,
সহায় তোমার স্মৃতি, ভোরস্মিত কবিতার মুখ। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হঠাৎ গুলির বর্ষা, ধোঁয়াবিষ্ট বাড়ি, আর্তনাদ ছাদ বেয়ে
মেঘে ওঠে, এলোমেলো পদশব্দ, মূক রক্তধ্বানি,
মেঝেতে চামচ, ভাঙা চায়ের পেয়ালা,
চন্দ্রাকৃতি কমলালেবুর কোয়া দেয়ালে প্রবেশ করে ভীত।তবু কেউ অপরাহ্নে হাঁটুরে ঠেকিয়ে
চিবুক নীরব বসে আছে, তার হাতে প্রেমিকের
স্পর্শ খেলা করে, ভাবে মৃত্যুর মুহূর্তে ভালবাসা
বড় বেশি প্রয়োজন; তার কোলো মাথা
রেখে শোয় তৃষ্ণার্ত পুরুষ।
কবিতার পঙ্ক্তি খোঁজে আনত চোখের কামরূপে
স্মৃতি স্বপ্নাচ্ছন্ন পাখি, মাথার ভেতরে গান গায়,
সুরে কালাকাল বাজে। একটি ফড়িং
বইয়ের ওপর দেয় প্রাণের উত্তাপ, তারপর আলগোছে
তরুণীর স্তনের সুঘ্রাণ নিতে যায়।পুরুষ আবৃত্তি করে মনে-মনে যেখানে কোকিল
আর গাইবে না গান, ফুটবে না ফুল, বাগানে কি
পথপ্রান্তে, ফসলের সজীবতা মুছে যাবে, প্রেম
চরম নিষিদ্ধ হবে, সেখানে আমার
নিঃশ্বাস নিশ্চিত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে লহমায়
মূঢ়দের খেলাচ্ছলে। পুরুষকে দলে পিষে একপাল
বাইসন ছুটে যেতে থাকে।স্বপ্নে তার ভ্রমরের ঝাঁক, সে পবিত্র বন্ধ দরজার
সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ভুল তীর্থযাত্রী, দ্বিধান্বিত,
কারা তাকে সরে যেতে বলে ক্রুদ্ধ স্বরে। প্রতিবাদহীন
একা
হেঁটে যায়, হেঁটে যায়; প্রকৃত সে যায়নি কোথাও। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | লোকে বলে বাংলাদেশে কবিতার আকাল এখন,
বিশেষত তোমার মৃত্যুর পরে কাব্যের প্রতিমা
ললিতল্যাবণ্যচ্ছটা হারিয়ে ফেলেছে-পরিবর্তে রুক্ষতার
কাঠিন্য লেগেছে শুধু, আর চারদিকে পোড়োজমি,
করোটিতে জ্যোৎস্না দেখে ক্ষুধার্ত ইঁদুর কী আশ্বাসে
চম্কে ওঠে কিছুতে বোঝে না ফণিমনসার ফুল।সুধীন্দ্র জীবনানন্দ নেই, বুদ্ধদেব অনুবাদে
খোঁজেন নিভৃতি আর অতীতের মৃত পদধ্বনি
সমর-সুভাষ আজ। অন্যপক্ষে আর ক’টি নাম
ঝড়জল বাঁচিয়ে আসীন নিরাপদ সিংহাসনে,
এবং সম্প্রতি যারা ধরে হাল বহতা নদীতে
তাদের সাধের নৌকো অবেলায় হয় বানচাল
হঠাৎ চড়ায় ঠেকে। অথবা কুসুমপ্রিয় যারা
তারা পচা ফুলে ব’সে করে বসন্তের স্তব।যেমন নতুন চারা পেতে চায় রোদবৃষ্টি তেমনি
আমাদেরও অমর্ত্যের ছিল প্রয়োজন আজীবন।
তোমার প্রশান্ত রূপ ঝরেছিল তাই সূর্যমুখী
চেতনার সৌরলোকে রাজনীতি প্রেমের সংলাপে।
যেন তুমি রাজসিক একাকিত্বে-মধ্যদিনে যবে
গান বন্ধ করে পাখি-কখনো ফেলোনি দীর্ঘশ্বাস,
যেন গ্রীষ্মে বোলপুরে হওনি কাতর কিংবা শুকনো
গলায় চাওনি জল-অথবা শমীর তিরোধানে
তোমার প্রোজ্জ্বল বুক হয়নিকো দীর্ণ কিংবা যেন
মোহন ছন্দের মায়ামৃগ করেনি ছলনা কোনো-
এমন মূর্তিতে ছিলে অধিষ্ঠিত সংখ্যাহীন প্রাণে।
গোলাপের তীক্ষ্ণ কাঁটা রিলকের সত্তার নীলিমাকে
ছিঁড়েছিল, তবু তাও ছিল স্নানাহার, চিরুণির
স্পর্শ ছিল চুলে, ছিল মহিলাকে নিবেদিতপ্রাণ।আমার দিনকে তুমি দিয়েছ কাব্যের বর্ণচ্ছটা
রাত্রিকে রেখেছ ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে, সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যূহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে। ঘৃণার করাতে জর্জরিত
করেছি উন্মত্ত বর্বরের অট্রহাসি কী আশ্বাসে।প্রতীকের মুক্ত পথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দের
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারই সাহসে।
অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয় চকিতে
নিয়েছ ভাসিয়ে কত অমলিন গীতসুধারসে।
ব্যাঙডাকা ডোবা নয়, বিশাল সমুদ্র হতে চাই
এখনও তোমারই মতো উড়তে চেয়ে কাদায় লুটিয়ে
পড়ি বারবার, ভাবি অন্তত পাঁকের কোকিলের
ভূমিকায় সফলতা এলে কিছু সার্থক জনম। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমি কি এখন সত্যি বেঁচে আছি? না কি জীবন্মৃত
পড়ে আছি বিড়ম্বিত মাস্তুলের মতো। বণিকের
খ্যাতি আছে কিছু টিকে, অথচ যাই না বাণিজ্যেতে
কতকাল, কতকাল সপ্তডিঙ্গা ভাসে না তরঙ্গে
সমুদ্রের জ্বলজ্বলে প্রাসাদের মতো হা আমার
মধুকর সেই কবে গেছে ডুবে কালীদহে। শুধু
আমি একা মাঝিমাল্লাহীন নির্বান্ধব খরস্রোতে
ভেসে ভেসে জলচর প্রাণীর লোভের বিভীষিকা
নিয়ত প্রত্যক্ষ করে পৌঁছে গেছি তীরে, কী বিহ্বল
ঠেকিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরেছি শ্মশানের কানি পরে।
বিপথে, অচেনা লোকালয়ে সম্বলহীন পথে
একমুঠো তণ্ডুলের জন্যে কাঠুরের সঙ্গে কাঠ
কেটেছি গহন বনে ঝরিয়ে মাথার ঘাম পায়ে,
পথকে করেছি ঘর। কতবার চ্যাঙড়ামুড়ি কানি
নানা ছলে কেড়ে নিয়ে আমার ঘর্মাক্ত দিনান্তের
কষ্টার্জিত অন্ন খলখল ব্যাপক উঠেছে হেসে,
ভেবেছে অভুক্ত আমি ক্ষুধার করাতে চেরা, ভয়
পেয়ে হবো নতজানু, ঘটে তার ঠেকাব আমার।
অবসন্ন মাথা দীনভিক্ষুকের মতো। তা হবার
নয় কোনো দিন; সত্য চাঁদ সদাগর যুবা নয়
আর, আগেকার উদ্দামতা শিরায় করে না খেলা
যখন তখন, এখন সে হন্তদীপ্তি, হীনবল,
সেই কবে অস্তমিত মহাজ্ঞান। একটি কি দুটি
নয়, ছয় ছ’টি ছেলে কালবিষে হয়ে গেছে নীল,
আমার সপ্তম পুত্র লখিন্দর, সে-ও সর্পাঘাতে
নেউল, ময়ূরময় সুরক্ষিত সাঁতালি পর্বতে
লোহার বাসর ঘরে কেমন মৃত্যুর মতো স্তব্ধ
হয়ে গেল, গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেলা অবেলায়
কলার মান্দাসে ভাসে লখিন্দর, বেহুলা বহুড়ী।
জীয়ন মন্ত্রের খোঁজে দয়িতের গলিত শরীর
আঁকড়ে তরঙ্গে নাচে সায়বেণে-নন্দিনী নাচুনি।
রাহুগ্রস্ত ঘর ছেড়ে
উঠোনে বেরিয়ে উন্মাদিনী
সনকা লুটিয়ে পড়ে পথের ধুলায় বারংবার।
‘কোথায় আমার লেখা’ বলে নিজেরই পাঁজরে করে
নির্দয় আঘাত আর নিঃসন্তার হরিণীর মতো
ঘোরে কত জনহীন আদাড়ে বাদাড়ে। আমি নিজে
বিকৃত মস্তিষ্ক এক জেদী, একরোখা লোক বলে
চম্পক নগরে পরিচিত আজ। হায়, দীপ্র, প্রিয়
নগরী আমার, একি দশা দেখি আজকে তোমার।
কেমন আন্ধার এলো নিষ্করুণ দশদিক ব্যেপে
চম্পক নগরে। সূর্যাস্তের পরে গেরস্ত রাখে না।পা তার নিজস্ব গৃহকোণ ছাড়া অন্য কোনোখানে
আজ, আর পথে পথে বঙ্গদাড়া, বিড়ঙ্গিনী আর
তক্ষক, শঙ্কর আর মহিজঙ্গ সাপের বসতি।
ঘরে ঘরে, এমনকি প্রত্যেকের মগজের কোষে
কোষে দোলে ফণা, নিত্য দিন-দুপুরেই
পথিক লুণ্ঠিত হয় জনাকীর্ণ চৌরাস্তায় আর
প্রহরী নিশ্চল দিকচিহ্ন শুধু। এখন বাছে না
ঠগ কেউ, পাছে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, উপরন্তু
নারীর শ্লীলতাহানি করে না অবাক কারুকেই।
সৎ অসতের ভেদাভেদ লুপ্ত, মিথ্যার কিরীট
বড় বেশি ঝলসিত দিকে দিকে, লাঞ্ছিত, উদভ্রান্ত
সত্য গেছে বনবাসে। বিদ্বানেরা ক্লিন্ন ভিক্ষাজীবী,
অতিশয় কৃপালোভী প্রতাপশালীর। নব্য কত
ক্রোড়পতি করে ক্রয় সাফল্যের অন্দর বাগান,
দরিদ্র অধিকতর দরিদ্র হবার ফাঁদে পড়ে
কাঁদে, করে করাঘাত দিনরাত সন্ত্রস্ত কপালে,
নীতির বালাই নেই, ঔদার্য, মহত্ত্ব ইত্যাদির
কানাকড়ি মূল্য নেই আর। আদর্শ বিনষ্ট ফল
যেন, নর্দমায় যাচ্ছে ভেসে; মতিভ্রম স্ফীতোদর
সফল বণিক, নগ্ন ক্ষমতার লড়াই চৌদিকে
উন্মুখের ভয়ংকর উৎসবের মতো আর দ্বৈত
শাসনের খাঁড়া ঝোলে দিনরাত মাথার ওপরে।
আন্ধার প্রথার কাছে আনুগত্য করেছে স্বীকার
স্বেচ্ছায় সবাই প্রায়, অদ্ভুত আচার, কুসংস্কার
মেলেছে অদৃশ্য ছাতা সুবিশাল, শিবিরে শিবিরে
ভীষণ বিভক্ত আজ বিপন্ন মানুষ।মোদ্দা কথা,
চম্পক নগরে সর্বনাশ পরাক্রান্ত জোতদার
আর আমি ধূলিম্লান পরাস্ত, বিফল ছন্নছাড়া
আন্ধার ভাঁটার টানে সে কোথায় উধাও আমার
সপ্তডিঙ্গা মধুকর, বুকের মানিক লখিন্দর।
আমি একা ডিঙির মতন ভাসি দুঃখের সাগরে,
এই আমি চন্দ্রধর বণিক আমারই রিক্ত ছায়া।
কোথায় নর্তকী আর কোথায় বিদ্যুৎ বাজিকর?
প্রকৃতই পরাভূত আমি? কপালে গ্লানির টিকা
বয়ে নিয়ে সারাক্ষণ কাটাব জীবন অচেতন
কীটপতঙ্গের মতো? যদিও ধ্বংসের পদচ্ছাপ
আমার জীবন জুড়ে রয়েছে করাল, তবু আমি
নিজেকে পরাস্ত বলে ভাবতে পারি না কিছুতেই।
মতিচ্ছন্নতায় অলৌকিক চালচিত্র দেখে ভাবি
জীবন সনকা তবু সনকাও নয়, দরিয়ায়
মধুকর, তবু মধুকরও নয়। তবে কি জীবন
শুধু ধু-ধু সমুদ্দুরে পাড়ি দেওয়া? কালবৈশাখীর
ঝড়ে কাষ্ঠখণ্ড ধরে ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে-যাওয়া?
বুঝি তাই আজও আমি সাঁতালি পর্বতে ঘুরে ঘুরে
মধ্যরাতে পাঁড় মাতালের মতো আরো এক ভাঁড়
মদিরার স্বাদ পেতে চাই খাদের কিনারে ব’সে।
জীবন জটিল একঅরণ্যের মতো জায়মান,
কখনো ভাবিনি আগে। প্রৌঢ়ত্বের তামাটে প্রহরে
কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতিও জটিল বড়, জানি
যা ঘটে এবং যা ঘটবে ভবিষ্যতে, সবকিছু
মানুষের চৈতন্যের অন্তর্গত, অবচেতনের
গোধূলিতে লীলায়িত ক্ষণে ক্ষণে। সেই যে প্রথম
গাঙ্গুড়ের জলে আমি ভাসিয়েছিলাম সপ্তডিঙা,
সনকার আগে যার সঙ্গে গোপনে করেছি কেলি,
তার স্তনচূড়া ত্রিবলির মদির চমক আর
কারুকাজ-খচিত বাসর ঘরে সনকার কালো
চোখের প্রথম চাওয়া, আলিঙ্গন, সলজ্জ চুম্বন,
গৃহকোণে পড়ে থাকা সুবর্ণ চিরুনি, উষাকালে
ভোরের আলোর মতো নবজাতকের আগমনী
চিৎকার এবং কালীদহে সঙ্গীদের বিপন্নতা,
গহিনে তলিয়ে যাওয়া, বিষধর সাপের অব্যর্থ
ছোবলে অকালমৃত পুত্রের শরীর, অবেলায়
গাঙ্গুড়ের জলে ভাসমান ভেলা এবং ভাঁড়ারে
খাদ্যান্বেষী মুষিকের নৈশ চঞ্চলতা, নিষ্ঠাবান,
সেবাপরায়ণ ন্যাড়া, দুঃখের দিনের সহচর,
তার পদ্ধতি, কিংবা বাণিজ্যেতে লভ্য চমৎকার
মুদ্রার ঝংকার, নরসুন্দরের গোঁফ, দূরাগত
ঝঞ্ঝাহত নাবিকের রহস্য-কাহিনী, মধ্যরাতে
শোনা কারো কণ্ঠস্বর-সবই তো আমাতে অন্তর্গূঢ়।
যা দেখি এবং যা দেখি না হয়তোবা অন্তঃস্তলে
করি অনুভব, তার মিশেলে যা গড়ে ওঠে, তাকে,
হ্যাঁ, তাকেই তো স্মৃতি বলে জানি। স্বরণ নাছোড় বড়;
সে তবে কোমল কোনো স্পর্শ লেগেছিল ত্বকে, সেই
সুখ আজও সঞ্চারিত হয় অনিবার্য মাঝে মাঝে
অভিজ্ঞ শিরায় আর যত স্বর শুনেছি একদা,
ওরা বেজে ওঠে শূন্য প্রহরের প্রহরে, সে গুঞ্জন
দেয় না আমাকে একা থাকতে কখনো। কিংবা যত
সুন্দর কুৎসিত দৃশ্য করেছি প্রত্যক্ষ, তার ছায়া
খুব ঘন হয়ে করে বসবাস আমার ভেতরে;
হঠাৎ ঢাকের শব্দ শুনি যেন, নাকি আমি
মদ্যপান-জনিত বিভ্রমে শুনি তীব্র বিস্ফোরণ-
মূলক আওয়াজ শুধু। এই তো সমুদ্র দিল ডাক
বাজিয়ে তরঙ্গশাঁখ; এ কোনো নিপুণ জাদুকর
বানায় নতুন ডিঙা সারি সারি চোখের পলকে?
কী এক আক্রোশে আজ
আমার জীবন অকস্মাৎ
প্রচণ্ড চিৎকার হয়ে ফেটে পড়তে চায়, পুনরায়
কালীদহে যেতে চায় এ জীর্ণ শরীর ভয়াবহ
সর্পকুণ্ডলীর মতো ঘূর্ণিজলে লড়বার খর
আকাঙ্ক্ষায়; জরার তমসা ঘিরে ধরেছে আমাকে;
মাথায় কালোর চেয়ে রৌপ্যবর্ণ কেশই বেশি আর
চক্ষুদ্বয় ছানিগ্রস্ত দীপ যেন, সাগ্রহে তাকাই,
অথচ দেখি না স্পষ্ট কিছু, শুধু দেখি অমঙ্গল
এসেছে ঘনিয়ে চতুর্দিকে এই চম্পক নগরে।
যেন এ নগরী আজ সম্পূর্ণ অচেনা পরদেশ,
যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই আর,
যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নেই, আর,
যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভীষ্ট
কোনো জয়গাথা নেই, কাকতাড়ুয়ার মূর্তি ছাড়া
অন্য কোনো মূর্তি নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া
অন্য কোনো বাসিন্দার আনাগোনা নেই। তবু আমি
বাঁচার উপায় নেই জেনেও এখনও আছি বেঁচে
হিন্তাল কাঠের কারুকাজ-খচিত লাঠিতে ভর
দিয়ে আর সমুদ্দুরে পাড়ি দেবার দুর্মর স্বপ্নে
সর্বদা বিভোর হয়ে। আর এই শ্মশানের কালো
ভস্মময় মাটিতে উবুড়-হয়ে-থাকা কলসের
মতো থাকব না পড়ে এক কোণে, এই তো আবার
আমাতে প্রত্যক্ষ করি বলিয়ান নবীন উত্থান।
উধাও বাতের ব্যথা, স্বচ্ছ দৃষ্টি, রক্তের ভেতরে
কেমন চাঞ্চল্য জাগে, যেন এক সম্পন্ন তরুণ
সদাগার চকিতে আমার সঙ্গে করেছে বদল
আপন অস্তিত্ব তার। এভাবেই কখনো কখনো
অন্য কেউ, দূরবর্তী কেউ এসে এসে যায় আমাদের
মধ্যে আর আমরা তখন তার মতো আচরণে
কিছুটা অভ্যস্ত হই, তার শক্তি, শৌর্য করে ভর
আমার ওপর পেয়ে যাই ভিন্ন দ্বিতীয় জীবন
বস্তুত অস্থায়ীভাবে। তারপর দক্ষ অভিনেতা
যেমন যাত্রার বেশভূষা ছেড়ে ফিরে আসে ফের
একান্ত আপন অবয়বে, তেমনি আমাদেরও ঘটে
করুণ প্রত্যাবর্তন; রাত্রির রুপালি স্বপ্ন মুছে
যায় অকস্মাৎ রূঢ় দিনে। অপার বিস্ময়, আজও
সাপের স্পর্শের মতো চমকিত অস্তিত্ব আমার।
যতদিন হিন্তাল কাঠের
লাঠি আছে হাতে, আছে
ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে
আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে
নিমেষে উঠবে ভেসে কোনো শোভাযাত্রার মশাল,
করব না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,
যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ,
ভিটায় গজাক পরগাছা বারংবার, পুনরায়
ডিঙার বহর ডোবে ডুবুক ডহরে শতবার,
গাঙ্গুড়ের জলে ফের যাক ভেসে লক্ষ লখিন্দর। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | নাছোড় ভাদুরে বৃষ্টি ভোরবেলা আমাকে দেবে না
বারান্দায় যেতে আজ। এবং তুমিও, হে অচেনা,
আসো না ছাদে, আঁচ করি,
সঙ্গে নিয়ে সহচরী!
বেশ কিছুদিন থেকে তোমার অমন রমনীয় উপস্থিতি
বস্তুত পাচ্ছি না টের। প্রীতি
নিও অবচেতনায়, শুভেচ্ছাও বটে, দূর থেকে,
যখন উঠবে ডেকে
পাখি সেই গাছে, যা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে, যার
পাতার আড়ালে তুমি আর
তোমার সঙ্গিনী হেঁটে বেড়াও প্রত্যহ, বলা যায়,
হাত ধরে, তোমাদের অশ্রুত কথায়
সাগ্রহে যে-কথা শুনি, তার
সঙ্গে মিশ আছে লতাপাতা, হ্রদের জলের আর নীলিমার।এই তো সেদিন, মনে পড়ে, গোধূলিতে
তিনজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন-বা আদায় করে নিতে
যুক্তি তর্কে কিছু কথা তোমার নিকট থেকে, পাশে
দাঁড়ানো বিহবল সহচরী, তুমি হাতে মুখ ঢেকে হতাশ্বাসে,
মনে হলো,বসে ছিলে,
আবছা সিঁড়ির ধাপে, খোলা দীর্ঘ চুল, আকাশের নীলে
উড্ডীন পাখির ঝাঁক নীড়ে
ফেরার দুর্মর টানে। সেই দৃশ্য অন্তর্গত গহন তিমিরে
ঋত্বিকের স্মরণীয় শটের মতোই গেঁথে আছে,
বৃষ্টি ঝরে খোলা বারান্দায়, ছাদে, মধ্যবর্তী গাছে।
হৃদয়ের আলতামিরায়
অগ্নি জ্বলে, স্মরণাতীতের প্রতিচ্ছবি পরা বাক্ পেতে চায়। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | একটি স্বপ্নের মাঝখানে হঠাৎ
আমার ঘুম ভেঙে যায়; দৃষ্টি মেলে দেখি
তখনও শেষ রাতের হাত
আকাশের কোমড়ে জড়ানো। বাইরে
বৃষ্টির মৃদু শব্দ, আমার মনে নামে
বিষণ্নতার নিস্তব্ধ কুয়াশা।স্বপ্নে তোমাকেই দেখছিলাম। আমরা,
তুমি আর আমি, একটি ফুটফুটে জ্যোৎস্নাপ্রতিম
বালিকার জন্যে সাজাচ্ছিলাম ঘর,
কোত্থেকে হিংসুটে এক ঝড় বুনো ষাঁড়ের মতো
তছনছ ক’রে দিলো সব, আমরা
একপাল শূয়োরের পায়ের তলায় ভীষণ জব্দ।
একটি মালা আমাদের দু’জনের হাতে
জড়িয়ে যাচ্ছিল মমতায়; কাঁচের মতো স্বপ্ন গেল ভেঙে।হাত মুখ ধুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একজন
চীনা কবির কবিতা পড়ার চেষ্টা করি; বার বার
দেয়ালে, বাইরে ঝাপসা ঘরবাড়ি আর গাছপালায়
দৃষ্টি যায়। মনের বিষণ্নতা
অধিকতর ঘন হয় এবং
তখনও তোমার অশ্রু-ফোঁটার মতো
বৃষ্টি ঝরছে
টিপ টিপ
টিপ টিপ
টিপ টিপ… (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যাবার সময় সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে পা রেখে পেছনে ফিরে তাকায় সে;
দোরগোড়ায় স্মিত মুখ, এক জোড়া চোখে ইদিশ ভাষার প্রাচীনতা। এগোনো
মুশকিল, তবু নেমে যাওয়া, হাত নাড়া। নেমে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে, নিচে হা
করা পাতাল। মনের ভিতর উথাল পাতাল।এখন রিকশায়; ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ট্রাফিক রাগী জন্তুর মতো গজরাচ্ছে। ওর
বসে থাকা, উঠে দাঁড়ানো, চায়ের পেয়ালা বাড়িয়ে দেয়া, হাসি, ওড়না
সামলানো, কিছু কথা, ফুলের ঝরে পড়া-মনে পড়ে। সে কী করবে এই মেঘলা
দুপুরে একা একা?সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, কোনও চিলেকোঠা নয়, ফ্ল্যাট বাড়ির ঘরের আশ্রয় খোঁজা
চুপিসারে। নারকেল গাছের অশ্রু জানালার গাল বেয়ে নামে। কে যেন
ফিসফিস স্বরে প্রাচীনকালের কবিতা পড়ে। এখুনি অফিসের ডাক, যাওয়ার
তাড়া। ঝাড়া চার ঘণ্টা কবিতার অনুলিপি তৈরি করা, চা খাওয়া, আড্ডা দেয়া,
সম্পাদকীয় লেখা না-লেখার দোটানা। হঠাৎ তাতারী তরবারির মতো ঝলসে
উঠে হানা দেয় সদ্য-অতীত। ঈষৎ শীত, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা বন্ধুর
গাড়িতে।বিছানায় শুয়ে ঘুমের প্রতীক্ষা; বলা-নেই না হওয়া কবিতার অবুঝ
গুঞ্জরণ মাথার ভেতর। ডুবে যাচ্ছে চোরাবালিতে, চিৎকার স্তব্ধ, কোনও দড়ি
কিংবা লতা নেই আশ-পাশে। মধ্যরাতে কাঁপুনি, কাকে ডাকবে? রাতের শেষ
প্রহরের প্রবল ঝাঁকুনি। ঠাণ্ডা বশ্যতা করে না স্বীকার কাঁথার, কম্বল, খোঁজে,
মাথা গোঁজে বালিশের নীড়ে। বশ্যতা ডেকে উঠবে কি?
রাত্রির মশক থেকে চলকে চলকে পড়ে তরল সোনা।২
লোকটাকে ওরা ক্রমান্বয়ে ক্ষেপিয়ে তুলছে। কারও পাকা ধানে মই দেয়া
তার কাজ নয়। নিজের হালেই আছে, হৈ চৈ থেকে দূরে থাকার বাসনা কাচের
বাসনের মতো চূর্ণ। তাই ওর মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। উঠে দাঁড়ালেই,
অনেকে ভাবে একটা হট্রগোল বাঁধাবে লোকটা, অথচ তেমন কোনও উদ্দেশ্য
গরহাজির। আস্তিন গোটানো ওর ধাতে নেই।মেপে মেপে কথা বলা, অট্রহাসিতে ফেটে না পড়া, সময় বুঝে আস্তে সুস্থে পা
ফেলা, কোনও দিকে মাটির ঢেলা না ছোঁড়া এসব যাবতীয় খুঁটি নাটি
লোকটার কাছে প্রত্যাশা ছিল সবার। এতো ভারি মজার আব্দার। সবাইকে
ঘুম পাড়িয়ে রাখার দায়িত্ব সে তো নেয়নি কখনও। সে চায় ধাক্কা দিয়ে ঘুমে
ঢুলুঢুলু লোকগুলোকে জাগিয়ে রাখতে, যখন জেগে থাকাটাই সবচেয়ে
জরুরি।ওকে নাস্তানাবুদ করার রাস্তা তৈরি করছে কেউ কেউ। ফেউ লাগানো হয়েছে
ওর পেছনে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার লোকের অভাব নেই
পাড়ায় পাড়ায়। গেরস্থবাড়ির কুকুর ভেউ ভেউ করে রাত দুপুরে তাড়ায় চোর
বাটপাড়। পুকুর চুরি বিরতিবিহীন উৎসব এখন।লোকটা ভাবে একবার নিথর চাকাটা ঘুরিয়ে দিলেই হলো, তারপর নিজের
গতিতে চলবে ঠিকঠাক। যে যাই ভাবুক, ইচ্ছা করলেই চাকা ঘোরানো যায়
না, পাহারাদাররা সেটা অচল রাখার জন্যে মোতায়েন। মগজে কাদা নিয়ে
যারা গাদা গাদা বই লেখেন, সৌন্দর্যের শরীরে যারা কুষ্ঠের জীবাণু ঢোকাতে
আগ্রহী, যারা মধ্যযুগীয় টিউমার সাজিয়ে দিচ্ছে সমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, তাদের
হাত থেকে সবাইকে বাঁচানোর তাগিদে ধুকপুকে বুক নিয়ে লোকটা জেগে
আছে লাল কমলের মতো।৩
আহত করো, যত পারো। সইতে পারব, কোনও আঘাতই আমাকে আর
কাবু করতে পারে না। সেই কবে তোমার হৃদয়ের কাছে তাঁবু ফেলেছি, মেলে
দিয়েছি আমার হৃদয় নীলোৎপলের ধরনে। একে একে সবগুলো পাপড়ি
তোমার দীর্ঘ নীখে তুলে নাও, হৃদয় থাকবে প্রতিবাদহীন।বলেছিলাম, তুমি কেমন সুদূর যেন বিষণ্ন প্রতিমা। এই শব্দগুচ্ছ তোমাকে ঈষৎ
রাগান্বিত করেছিল বলে মনে হলো। বুঝি আজও জের চলছে তার। না কি
আমি নিজেই বানিয়ে তুলছি মনে-মনে এমন কিছু, যা তোমার ভাবনার
ত্রিসীমানায় অনুপস্থিত?‘ভালো থেকো;, বলেছিলে রিসিভার ক্রেডলে রাখার মুহূর্তে। কিন্তু কী করে
ভালো থাকি যখন তুমি, হ্যাঁ, তুমিই আমার মনের স্তরে স্তরে কালো মেঘ
ছড়িয়ে দাও বারবার। তোমাকেই ঘিরে আমার সকল ভাবনা আর স্বপ্ন।
ভোরবেলা হেঁটে যাওয়ার সময় দেখি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো পথের মোড়ে,
বইয়ের দোকানে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তোমাকে দেখতে পাই বিদেশী
কাব্যগ্রন্থের জ্যাকেটে, রাতে শুতে গেলে দেখি তুমি আমার চেয়ারে বসে পা
দোলাচ্ছো মাত্রাবৃত্তে। ছুঁতে গিয়ে তোমার ছায়াকেও পাই না। তোমার
অনুপস্থিতিতে ক্রমাগত অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।কেন তুমি অমন করে তাকাও আমার দিকে? তুমি কি জান না আয়ত এই দৃষ্টি
আমার হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিতে পারে? তোমার হাসির মাধুর্যে আমার হৃদয়ের
আরশি নগরে যে পড়শি বসত করে সে দোতারা বাজাতে বাজাতে দূরে
কোথাও যাত্রা করতে চায়, তুমি কি বুঝতে পারো?যত পারো আহত করো। এই পরিণতি সেদিনই মেনে দিয়েছিলাম, যেদিন
প্রথম তোমার চোখে চোখ নয়, হৃদয় স্থাপন করেছিলাম। এ হৃদয় তুমি ছিঁড়ে
খুঁড়ে ফেলে দাও পথের ধারে, যেখানে মানুষ আর পশুর পায়ে দলিত হবে
হৃৎপিণ্ডের টুকরোগুলো। কেউ জিগ্যেশও করবে না, কে ধারণ করেছিল এই
রক্তাক্ত খণ্ডসমূহ?৪
আঃ, আমাকে বাঁচাল এই বিকেল। সকাল বেলা থেকে, বলা যায়, ছিলাম
প্রায় মৃত। বাসায় রোবটের মতো ঘোরাফেরা সারাক্ষণ। অকস্মাৎ ঘরে বসন্তের
প্রবেশ বাসন্তী রঙের ঝলক এক পলকে রোবটের মধ্যে করল প্রাণ সঞ্চার।বসন্ত চেয়ারে বসে বলে, ‘এলাম চলে। শোনো তো, এই বিবর্ণ ফুলগুলো
ফেলে দাও। শুকনো ফুল দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।
অতিশয় ম্লান ফুলগুলোর পাশে ওকে মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত।‘অন্তত আজ থাক ওরা এখানেই’, নিষ্প্রাণ ফুলগুলোর গায়ে হাত বুলোতে
বুলোতে দিলাম জবাব। ইচ্ছে হলো ওকে, বসন্তকে, বলি, ‘আমিও তো বিবর্ণ,
জীর্ণ। তা বলে তুমি কি আমাকে ছুঁড়ে দেবে আঁস্তাকুড়ে?’ শেষ অব্দি বলা হলো
না, নিশ্চুপ পান করে চলি বসন্তের সৌন্দর্য।বিদায়ের ঘণ্টা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বসন্ত। যে
যাবেই চলে তাকে ফেরানোর মন্ত্র আমি শিখিনি। একটা হাহাকার বারবার
আমাকে উদাস, বিষণ্ন জলাশয়ে ডুবোতে থাকে। ভুলে ছিলাম এই বিকেল
আমার শিরায় কোরামিন সঞ্চারিত করেছিল। এখন অন্ধকারে ইঁদুরের দল
আমাকে খেতে শুরু করলেও, ওদের তাড়ানোর ধৈর্য আমার ভগ্নপক্ষ, নখর ও
চঞ্চুবিহীন ঈগল।৫
ফল কাটার ছুরি আমূল বিদ্ধ হৃৎপিণ্ডে। হাতলে দু’টি প্রজাপতি। স্বপ্নে-দেখা
শল্যচিকিৎসক দাঁড়ানো কফিনের গা ঘেঁষে, জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চেটে কখন
যে তিনি ঘাসফড়িং, বুঝতে অক্ষম। হৃৎপিণ্ড থেকে ছুরি কনক চুড়ি রূপসীর
হাতে। আজকাল কী যে হচ্ছে, কখনও শুক্রবারকে মনে হয় সোমবার, কখনও
বুধবার রোববারের আদল ধরে। একটা ব্রেসলেট তার হাতে পরাতে গিয়ে
দেখি, পলঙ্কার নয়, সাপ জড়িয়ে ধরে ওকে। পেছনে হটতেই পিঠ দেয়ালে,
সাপিনী মোহিনীর রূপে এগোয় আমার দিকে। একঝাঁক প্রজাপতি আমাদের
মাঝখানে দোদুল্যমান ঝালর। ঘাসফড়িং পুনরায় দক্ষ শল্যচিকিৎসক, বাইপাস
অস্ত্রোপচারের জন্যে তৈরি বৈরী ঋতুতে। ঋতু বদলের প্রতীক্ষায় বসে আছি
ঝড় বাদলে, লম্বা করিডোরে, মেঘের মাদলে মিয়া কি মল্লার। দূর পাল্লার যাত্রী
কেউ আছে কি এখানে। হাসপাতালের বেডের শিথানে পাশে। খেলে একজন,
পরনে তার কালো আলখাল্লা। ঠাণ্ডা পাথর বিছানায় উঠে আসে, কবি পাথর
বুকে টেনে ঘুমান। পাখির গানেও তার ঘুম ভাঙবে না। তার শরীর থেকে
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে আঙুরের রস। শল্যাচিকিৎসক খস খস করে কী যেন
লিখছেন টুকরো কাগজে ঝোড়ো বাতাসে নার্সের ত্র্যাপ্রন এখন গাঙচিল।
কবির বুকের পাথর সরিয়ে দাও।৬
ভেঙে ফ্যালো, আর নয় কালক্ষয়। হাতে তুলে নাও হাতুড়ি ও ছেনি।
এতকাল শুধু গড়েছ এলেবেলে ভুল পুতুল। এবার গড়ো আনকোরা সৌন্দর্য,
কালের ধুলোর স্পর্শাতীত। মাইকেলেঞ্জলো থেকে হেনরি মূর-যুগেশ্বর সবার
জন্যে লাল গালিচা; তুমি হেঁটে যাবে ঘেসো অথবা এবড়ো থেবড়ো পথে।সময় মোমবাতির মতো দ্রুত গলছে, হাত চালাও জোরেশোরে। পাথরের কুচি
ঢেকে ফেলুক তোমাকে, তবু বিশ্রামের মদে চুর হয়ো না। এই তো অদূরে
সত্য আর পবিত্রতা তোমার রূপায়ণের অপেক্ষায়। ঠাঁই দাও পাথরে, অমর্তের
সঙ্গীত হোক মর্মরমুর্তি। সে গানের মূর্ছনা শ্যাওলা ছিঁড়ে বিশ্বের সকল সীমান্ত
পেরিয়ে যাক।গত রাতে স্বপ্নে আমাকে কেউ ভাঙার গান শুনিয়েছিল। এখনও অটুট স্বপ্নের
স্বায়ত্তশাসন, দেয়ালে ডানা যুগ্মতায়, উড়ে যাব, প্রফুল্ল ঘুড়ি আকাশে আকাশে
ফিসফিসানি।৭
ধাপ্পা, অনাস্থা, ধান্দা মর্গে যায় না, কাটা ছেঁড়া নেই। বিদেশ থেকে কফিন
উড়ে আসে মেঘের নানা স্তর ভেদ করে। আশশ্যাওড়ার বনে সবুজ টিয়ে
চওড়া অ্যাভিনিউতে বিয়ের গাড়ি। টিয়ে ফুটপাতে বান্ডিলের মতো পড়ে
থাকে, মর্গে যাবে না। ময়না তদন্তের প্রয়োজন নেই ওর। পাখির জগতেও
ফিরবে না আর। কফিনে এক জোড়া শাদা হাত, ছড়িয়ে-পড়া চুল, কফিন শুষে
নেয় ক্রন্দন। কারা ভুল করে যেপথে যাওয়া উচিত ছিল, সেপথে না গিয়ে
ডোবায় পড়ে হাবুডুবু খায়। একজন চৌরাস্তায় ক’খানা হাড় নিয়ে মাদারির
খেল দেখায়। ‘সব কিছুই মস্ত ধাপ্পা’, হনহনিয়ে চলে যায় অন্যজন।
সমস্ত শহর কী দ্রুত কাদায়, বিষ্ঠায় ডুবে যাচ্ছে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার
করার মতোও কেউ রইল না। তবে কীসের ধ্বনি যাচ্ছে শোনা? ন্যালাক্ষ্যাপা
একজন কাদায় ডুবতে ডুবতে বাজাচ্ছে মাউথ অর্গান। ওকে তুলে ধরো, বলছে
সিংহের কেশরের মতো মেঘ, বলছে দূর দিগন্ত। করুণ সুর সূর্যাস্তে মিলিয়ে
যেতে থাকে, যেমন নাট্যমঞ্চে যবনিকা পতনের সময়ে হয়। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ)
|
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কখনও এমন হয়, নিজেকে বড়ই
বেগানা কে এক লোক বলে
মনে হয়। যখন আমার দিকে কেউ
তাকায় অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে, বেজায় ভড়কে যাই।যখন যেখানে যাই তখনই সবার দিকে হাসি-
মুখে কথা বলি সকলের সঙ্গে যদি
বেজায় ঝিমিয়ে পড়ি, তা হ’লে নানান পথে হেঁটে
পৌছে যেতে পারি ঠিক জ্বলজ্বলে কাঙ্ঘিত প্রদেশে।ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার চৌদিক ঘিরে আছে
ক’জন জবরদস্ত অস্ত্রবাজ। নির্ঘাত দুর্দশা
ভেবে নিয়ে আকাশের দিকে চোখ মেলে ধুকধুকে
বুক নিয়ে চির-অন্ধকারের আশায় চোখ খুলি, বন্ধ করি।হঠাৎ কে যেন দূরে গান গেয়ে পরিস্থিতি দ্রুত
বদলে আমার মনে অপরূপ কিছু
তরঙ্গের সৃষ্টি করে। উপরন্তু কতিপয় নরনারী নেচে গেয়ে প্রাণে
আমার বাগান তৈরি করে আর আমি অন্য কেউ হয়ে যাই।কেন যে হঠাৎ আশেপাশে কখনও না-দেখা মুখ
জেগে ওঠে, ওরা বড় মধুর সুরের ঢেউ তুলে
চারদিকে গ’ড়ে তোলে নতুন অপূর্ব গেরস্থালি। আমি সেই
সৃষ্টির আলোয় দীপ্ত হয়ে কেমন আলাদা, স্বর্গফেরা! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | আমার ভেতরকার ছবিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে
ওঠার অক্লান্ত সাধনায় চার দেয়ালের খাঁ খাঁ
পরিধিকে কেবলি আঁকড়ে ধরে। স্তব্ধতায় ঢাকা
মুহূর্তগুলিকে আমি কী সহজে অবিরত ক্ষয়ে
যেতে দিচ্ছি। বৃক্ষচারী কোকিলেরা নিয়ত বমন
করছে স্বপ্নের দলা, স্বপ্নহীন যারা তারা দলে
দলে জোটে শোরগোল তুলে দিনরাত বৃক্ষতলে,
ওরা শুধু কোলাহলে মাটি করে হৃদয় রতন।আমি তো তোমারই স্বপ্নে ডুবে থাকি হৃদ সরোবরে,
জাগরণে যখন কবিতা লিখি, তুমিই তখন
স্বপ্ন হয়ে ধরা দাও, এত কাছে বসো, পারি ছুঁতে
হাত বাড়ালেই আর আমারই কবিতা মৃদুস্বরে
পাঠ করো বস্তুত স্বপ্নের জন্যে কোনো ঘন বন
কিংবা দাতা পাখির নিকট প্রার্থী হই না কিছুতে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সেই কবে থেকে শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় না,
মস্তিতে রাখে বন্দী, ঘুমোতে দেয় না শান্তিতে, ক্রুদ্ধ
পাখির মতো
একটানা ঠোকরাতে থাকে সকাল সন্ধ্যা, ঘোরায়
অবিরত বনবাদাড়ে, আলো আঁধারে,
তৃষ্ণায় জিভ বেরিয়ে-আসা মাছে, যেখানে
গ্রাম্য বধূর লাশ পশুর লোভের করাতে অপভ্রংশ,
সনাক্ত করণের পরপারে। শব্দ আমাকে হাতছানি দিয়ে
ডেকে নিয়ে নাকানি চুবানি খাওয়ায় খানাখন্দে।কখনো কখনো প্রতিশোধ আমার মধ্যে
লকলকে আগুন, হঠাৎ
কোনো কোনো শব্দের গাল পুড়িয়ে দিই, কান
মুচড়ে দিই, যেমন কোনো যন্ত্রী সুর বাঁধার সময়
বাদ্যযন্ত্রের কান। আবার কখনো
লাঠির ডগার ঘোরাই বনবন, তপ্ত কড়াইয়ে ভাজি,
করাই সেবন কবিরাজী তেতো বড়ি, নেহাইয়ে ফেলে
বার বার মারি হাতুড়ির বাড়ি, কাস্তে দিয়ে কর্কশ কাটি।রাত্রির জঠরে দাঁড়ানো শেয়ালের চোখ থেকে,
বরজাশ্রয়ী পানপাতা থেকে, অনূঢ়ার স্তন থেকে, ঈগল
আর সাপের অমীমাংসিত বিবাদ থেকে, ভোরের
স্পর্শ-লাগা
ডিমের কুসুম থেকে, সন্ন্যসীর পিঙ্গল জটা, অমিততেজ
শহীদের বুকের গোলাপ ফুটো, মগরেবে হঠাৎ-দেখা
সিজদারত মানুষের চন্দ্রাকৃতি, সুরাইয়ের ছায়া,
পূর্বপুরুষদের অস্পষ্ট পদধ্বনি আর
বল্লমবিদ্ধ গলার আর্তনাদ থেকে টপকে পড়ে শব্দ।
শব্দ ত্র্যারিয়েলের রেশমপ্রতিম
পাখার আন্দোলনের সত্য।
শব্দ জলাভূমির ধারে গোধূলিতে
ক্যালিবানের আলস্যময় শয়নের সত্য।
অর্ধপশু অর্ধমানবের রোমশ হাতে
নির্জন জল ঝকঝকে আয়নার মতো
টুকরো টুকরো হয় এবং আমি বেলা অবেলায়
জোড়া লাগনোর খেলায় মেতে উঠি। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কিছুদিন থেকে আমি অতিশয় মনোকষ্টে আছি
একটি সংসার খুব খাপছাড়া অথচ সুন্দর,
স্বতন্ত্র সাজাবো ভেবে কিছুকাল ছিলাম বিভোর।
এ ব্যাপার কিছুতেই হওয়ার নয় বলে চলে গ্যাছে
পাথরের মতো কেউ, পড়ে আছে এখানে সেখানে
শেকড়-বাকড় আর সম্পর্কের ছিন্ন তন্তুজাল।মদ্যপ যেমন তার শূন্য বাসি গেলাশের দিকে
তাকায়, আমিও তেমনি চেয়ে থাকি নিজস্ব আয়নায়
মাঝে মাঝে। কোনোদিন মুঠোয় আমার জুঁই কিংবা
চামেলী ছিল কি সত্যি? আজ হস্তময় ঘূণপোকা।ক্ষ্যাপা, বড় ক্ষ্যাপা এই মন দীর্ঘ সূতো ছেড়ে ছেড়ে
লাটাই করেছে শূন্য। হায়, সুদূর মেঘের ঘুড়ি,
উড্ডীন রঙিন ঘুড়ি ফিরে আসবে না কোনোদিন।
হৃদয়ে অনেক মৃত প্রজপতি, মরাল-কংকাল।স্বপ্নের ভিতরে ক্ষিপ্র ডালকুত্তা শোঁকে আমার
সর্বক্ষণ ধেয়ে আসে পেছনে পেছনে। রুদ্ধশ্বাস
আমি শুধু খুঁজি বনবাদাড়ে আশ্রয়, কিন্তু, হায়,
জঙ্গলও ভীষণ লোকালয়। স্বপ্নে ভিতরে ঘোরে,
আমার চৌদিকে ঘোরে কী কর্কশ কান ঢাকা ছায়া,
সাপ ওড়ে,আমি নগ্ন, একা ধ্বস্ত কবরখানায়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কী করে প্রকাশ করবো আমার আজকের
অনুভূতি? কাল রাত্তিরে যন্ত্রণার ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে
শেষ প্রহর পর্যন্ত নির্ঘুম কাটিয়েছি, যতক্ষণ না
মুয়াজ্জিন ফজরের আজানের সুর ছড়িয়ে দিলেন
ঘুমন্ত পাড়ায়। আজ আমি পদ্মফুলের অজস্র
পাপড়ির আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছি, আমার সকল
রোমকূপে আনন্দধারা, এই মুহূর্তে আমি বসন্ত বাহার;
কেননা, দু’সপ্তাহ পর তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি।এই লক্ষ্মীছাড়া কবিকে তুমি রক্ষা করলে
কথার ঝরনাতলায়। যে অভিমানের জ্বালাধরানো
ক্রূর শুঁড়গুলি ক্ষত তৈরি করছিল হৃদয়ে, যেসব
এখন শুকনো পাতার মতো খুলে গ্যাছে,
এখন আমি স্নিগ্ধ সরোবরে সাঁতার কাটছি আর তোমার দিকেই
ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে মাছের মতো আমার দু’টি স্পন্দিত হাত। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সময়ের প্রশংসা করবো বলে আমরা ক’জন
খুজি কিছু বাছা-বাছা চিত্রকলা, উপমা প্রতীক
মগজকে হুকুম খাটিয়ে। কল্পনার জামেয়ারে
সত্তা ঢেকে দেখি ক’টি অপোগণ্ড পোকা ইতিমধ্যে
রূপক করেছে নষ্ট। দর্শনের মেরাপ-বাঁধানো
প্রাঙ্গণ কয়েক বিঘা জুড়ে আছে, একটি জিজ্ঞাসা
ভেঙে চুরে হাজার জিজ্ঞাসা আড়চোখে চেয়ে থাকে
দ্বিধান্বিত নীলিমার দিকে। আমরা চেঁচিয়ে মরি
সমস্বরে- ইতিহাস লেখে কতো কাকের ছা বকের ছা-
পাই না স্তুতির ভাষা। কয়েক পুরুষ অপেক্ষায়
স্থিত হলে হয়তো উজ্জ্বল লোকভাষা জন্ম নেবে,
কবিত্বের শৃঙ্গারে বাড়বে জানি কালের জৌলুস।আমরা কয়েকজন আমোদ প্রমোদ ক্লান্ত হয়ে
আত্মপরিচয় ঢেকে ব্যক্তিগত বিকারী ধোঁয়ায়
দুশ্চিন্তার উপদ্রবে ছিঁড়ে ফেলি শিল্পের জটিল
অন্তর্বাস, পণ্ড করি, কনাব, তারার শুদ্ধ খেলা।কী ভ্রান্তিবিলাসে দেখি ধাতুর প্রাসাদে কয়েকটি
অন্ধ ঘোড়া রাত্রিদিন ঘোরে এক অর্থহীনতায়ঃ
তাদের আরোহী নেই, মালিকানা জানা নেই কারো
ত্রিধাতু নির্মিত সেই প্রাসাদের। অন্ধ ও বধির
ঘোড়াগুলি নক্ষত্রে বমন করে, লেজের দাপটে
তাড়িয়ে বেড়ায় খোজা ক্রীতদাস, নগ্ন ক্রীতদাসী
সর্বক্ষণ একই বৃত্তে। অবিবেকী সুরে স্তূপীকৃত
শব হলো ছিন্নভিন্ন, চতুর্দিক নক্ষত্র, বিষ্ঠায়
মতিচ্ছন্ন একাকার। আশেপাশে যা-কিছু চোখের
চাওয়ায় এখনো স্পষ্ট, জোবজগতের সেই সব
আনন্দ সঙ্কট ত্রাস প্রতিক্রিয়া খোঁজে মননের
তীব্র সত্যে, স্বচ্ছতায়। কিন্তু আজো ক’পা বাড়ালেই
পণ্ড হয় চৈতন্যের নব্য নাট্য, মনন গোঙায়!আমাদের পিতৃপুরুষের চেনা রূপলোক আজ
ব্যঙ্গচিত্র বর্ণাভাসে চৈতন্যের বিনিদ্র নিষ্ঠায়,
জীবন যাত্রার নাটে। যখন বাতিকগ্রস্ত আলো
গাধার চিৎকার হয়ে ফেটে পড়ে ধাতুর চত্বরে,
আমরা কয়েকজন একচ্ছত্র ভীষণ পিতলে
নীলিমা মিশিয়ে কিছু, মানবিক গলিঘুঁজি ঘেঁটে
ভুলে যেতে চাই এই শতকের জলাতঙ্ক, দূর
সমাজের সুখসঙ্গ, ভুল রূপকের খেসারৎ!সমস্ত আকাশে চাঁদ পিটিয়ে রুপালি কানাস্তারা
আস্তাকুঁড়ে ভাবুককে বেকুব বানায়। অবসাদে
হাই তোলে ইতিহাস। হরিণ এবং খচ্চরের
সংগমে নিতেছে জন্ম অদ্ভুত বেখাপ্পা জন্তু সব।পৃথিবীকে বদলাতে পারি না আমরা, পারবো না
ওষুধবিষুধ দিয়ে কিংবা ঝাড়ফুঁকে পৃথিবীর
শুশ্রূষা করতে। শুধু কিছু উপমা প্রতীক আর
চিত্রকল্পে শিল্পের শুদ্ধতা দেব ভাষার গতিকে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কত সাধ করে হরফের নীড় সাজিয়ে ছিলাম; তড়পানো
পান্ডুলিপি, বাবুই পাখির বাসা যেন, খর তুফানের তোড়ে
এঁটেল মাটিতে গড়াগড়ি যায়, খড় সমুদয়
কুড়িয়ে আবার জড়ো করি, বিষাদের চোখ জ্বলে
নিরালায়।এখনই কি উদ্যমের সোনালি প্রন্তর ছেড়ে অসহায় চলে
যাব কালো কুটিরে একাকী, অবনত? মুখ ঢেকে
রাখব হাঁটুতে ক্লান্ত, শস্যহারা কৃষকের মতো? প্রত্যাশার
শব পোড়ে ধোঁয়াটে শ্মশানে, ভয়ে চোখ বন্ধ করব না
আর।কলকলে জলে ধুয়ে যাবে জেনেও বালক নদীতীরে গড়ে
সাধের বালির ঘর; আমিও কি অনুরূপ খেলা
নিয়ে মেতে আছি নিত্যদিন প্রতারক ভরসায়
শব্দের অতীত শব্দ ছুঁয়ে ছেনে? আমি এই খেলা ছাড়ব না।আমার ললাটে আজ যৌবনের ভস্মটিকা, রক্তে হিমঝড়
অত্যাসন্ন, কে এক কংকালসার, ভয়ঙ্কর লোক
নিঃশব্দে আমাকে হাত ধ’রে টেনে নিতে চায় হু হু
হাড়ের উদ্যানে, আমি তার সহযাত্রী হ’তে অস্বীকার করি।পুনরায় সকালবেলার রোদ চিকচিক করে মেরামত-করা
হরফের নীড়ে আর অস্ফুট শব্দের শিশু গলা
বাইরে বাড়িয়ে দেয়। এই আয়োজন সঙ্গে নিয়ে
স্বপ্নঙ্কিত পতাকা উড়িয়ে যাব আকাঙ্ঘিত গোলাপ বাগানে। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | কোথাও একটা কিছু গলদ রয়েছে সুনিশ্চিত,
নইলে কেন এত ছটফটানি এবং কাতরানি আশেপাশে?
না, না, কারারুদ্ধ নই; এ শহরে যখন যেখানে খুশি
হেঁটে যেতে পারি, ইচ্ছে হ’লে
প্রত্যহ সকালবেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যায়
যথারীতি, সন্ধ্যেবেলা স্ন্যাকবারে, রাত্তিরে কোথাও
রেস্তোরায়ঁ ব’সে থাকা অসম্ভব নয়। মাঝে-মাঝে
ফুলের সুঘ্রাণ পেলে ভালো লাগে আর
টেলিফোনে মানোমুগ্ধকর
কথোপকথনে বেলা ব’য়ে গেলে খুশি।অথচ কেন যে প্রায়শই অস্বস্তির কাঁটাগুলি
বেড়ালের নখরের মতো
ক্রমাগত ভীষণ আঁচড় কাটে অস্তিত্বে আমার। সন্ত্রাসের
কী ব্যাপক বিদঘুটে থাবার তলায়
দিন যায়, রাত কাটে। হায়েনারা মানচিত্র নিয়ে
স্বেচ্ছাচারী, নেকড়ের পালের কামড়ে
ফালা ফালা স্বপ্নের পতাকা। কখন যে
নিজেই নিজের বমি হাভাতের মতো গিলি খেয়াল থাকে না।কয়েদখানায় নয়, বাইরেই আছি। তবু কেন স্বাভাবিক
প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন টেনে নিতে পারি না সম্প্রতি
প্রহরে প্রহরে আর? দম বন্ধ হ’য়ে আসে, শুধু
হাঁসফাঁস; কারা যেন মুখের উপর
খুব জোরে চেপে ধরে নিরেট বালিশ,
যেমন সুদক্ষ খুনী কাজ সারে অবলীলাক্রমে। প্রাণপণ
চিৎকার করতে গিয়ে দেখি
সকল আওয়াজ স্তব্ধ, বুক ফেটে যায়। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এই যে আমি কে জানে কতদিন, কতকাল পর
সোঁদা মাটির ভেতর থেকে আচানক বেরিয়ে এসে
তাকাচ্ছি এদিক সেদিক, কে এই আমি?
এমন সুনসান এলাকায় কোন্ মানব বলে দেবে কে আমি?থমথমে নৈশ প্রহরে মাটির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে
কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হলো
নিজেকে। আত্মপরিচয় কোথায় কখন যে হঠাৎ
লুপ্ত হয়েছে! নামহীন, ঠিকানাবিহীন, কে
বলবে?মাংসহারা, হাড়সর্বস্ব আমার শরীর কবর থেকে
বেরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিকেলের মৃত রোদ
আমার প্রবীণ কঙ্কালের সঙ্গে
ইয়ার্কি মারার মতলবে ঘন ঘন
চুমো খায়, সুড়সুড়ি দেয় মাংসবিহীন
বগলে। আমার কঙ্কাল হাঁটতে থাকে দিশাহীন।আমার করুণ কঙ্কাল বিরান গোরস্তানে
অদৃশ্য মহিমায় পথ চলে, দেহলগ্ন মাটি
খসে না কোথাও। হঠাৎ দু’টি কাক কোত্থেকে
উড়ে এসে সওয়ার হয় আমার কাঁধে। চেঁচাতে
চেষ্টা করে প্রাণপণে, অথচ নীরবতা! ভর করে
ওদের ওপর। হঠাৎ তিনটি কোকিল কিয়দ্দূরে
মহানন্দে সুরের ঝরনা সৃষ্টি করে। আমার
কঙ্কাল কারও চোখে পড়ুক না পড়ুক,
কোকিলের সুর সজীব।গলায় বজ্রপ্রায় আওয়াজ এনে
নিজের উপস্থিতি প্রচারে শত চেষ্টা
সত্ত্বেও ব্যর্থ হই বারবার। শরীরের ভীষণ
শুষ্ক, ভঙ্গুর হাড়গুলো শীতার্ত গাছের
পাতার মতো ঝরতে থাকে। আকাশে
নক্ষত্রের ঝাঁক মেতে ওঠে উপহাসে। বিরান
গোরস্তানের স্তব্ধতাকে মাঝে-মধ্যে সঙ্গীতের
আভা দিয়ে
সাজিয়ে তোলে কোকিলের করুণ আহ্বান। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | তার হাতে কোনো মন্ত্রপূত ডুগডুগি
অথবা জাদুর বাঁশি নেই,
তবু কেন ওর পেছনে পেছনে ছুটে চলেছে এত লোক?
ছোট ছোট হৈ-হৈ ছেলেমেয়েরা ওর পিছু নেবে,
এমন উন্মাদ সে নয়। মাথা উঁচিয়ে
সে হাঁটছে, দৃষ্টি দূর দিগন্তের দিকে।কোনো রঙিন বিজ্ঞাপনের ফুরফুরে কাগজ
সে উড়িয়ে দিচ্ছে না হাওয়ায়,
তার হাত থেকে ঝরছে না রাজনৈতিক ইস্তাহার।
কাউকে কাছে ডাকার
স্পৃহা লতিয়ে ওঠেনি, তার মনে, বরং সে
নিজের ভেতর ডুবসাঁতার দেয় সারাক্ষণ।মাঝে-মধ্যে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে
সে ভাবে- এই প্রাচীনকালের মুক্তোর মতো চাঁদ
ঝুঁকে আছে তার উপর, চকচকে কিছু মাছ
তন্দ্রার তটে এসে বুড়বুড়ি কাটে, এরা কি মনে রাখবে
তাকে? আর যারা না চাইতেই ওর পিঠ
লক্ষ ক’রে ছোটে উদ্দাম, একদিন তারা ওকে
পায়ে মাড়িয়ে যাবে না তো? সে কি তখন
মাংসের করুণ দলা হ’য়ে পড়ে থাকবে ধুলোয়?
না কি সে মন্ত্রটন্ত্র ছাড়াই কোনও চৈত্রপূর্ণিমায়
হ’য়ে যাবে মনপবনের দাঁড়! (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে সারারাত সহবাস করে
বেদনা ভুলতে গিয়ে আরো বেশি বেদনার্ত হই।
১৪০০ সালের আশা সত্তাময় মেখে নিতে চেয়ে
ক্রামগত বুনো অন্ধকারে ডুবে যাই।ক’দিন দু’চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই, চর্তুদিকে বিভীষিকা
নানান মুখোশ পরে নাচ জুড়ে দেয়, অন্ধকারে
আমার একান্ত পাশে মৃত্যু শুয়ে তাকে,
হিয়ায়িত মিসাইল যেন।হায়, সোমালিয়ায় মরছে কারা? মানুষ, মানুষ।
হায়, বসনিয়ায় মরছে কারা? মানুষ, মানুষ।
হায়, বসনিয়ায় ধর্ষিতা কারা? মায়েরা, বোনেরা।
বোম্বে, আর দিল্লী নগরীতে খুন হলো কারা? মানুষ, মানুষ।
ভোলায় আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরেছিল কারা? মানুষ, মানুষ।
প্রচ্ছন্ন মানিকগঞ্জে ধর্ষিতা হয়েছে কারা? মায়েরা বোনেরা।
সেখানে লুণ্ঠিত কারা? মানুষ, মানুষ।
এখানে লুণ্ঠিত কারা? মানুষ, মানুষ।‘মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়’-
মানবতা প্রায়শই ব্যধভূমিতে চলেছে, হায়।মৃত্যু প্রতিদিন খবরের কাগজে নিজের মুখ
পাখি-ডাকা সকালে দেখতে পেয়ে নিজেই আঁৎকে ওঠে খুব;
তবু মৃত্যু নিজেকে সাজিয়ে রাখে কম্পিউটারের
ঝকঝকে হরফে এবং বিজ্ঞাপিত হয় ভাঙনপ্রবণ বিশ্বময়।আমরা কি মৃত্যুর ফরমাশ খেটে নিত্যদিন মনুষ্যত্ব
শ্মশানে ও গোরস্থানে ফেলে রেখে মানুষের প্রাণ
লুটে নেবে? ১৪০০ সালের সূচনায় বিশ্ববাসী
এসো আজ আমরা সবাই হৃদয়ের গানে গানে
গোধূলির মেঘ থেকে রক্তচিহ্ন আর ষড়যন্ত্রকারীদের
কালো খাতা থেকে সব আতঙ্কের নকশা মুছে ফোলি।
চারণ কবিরা সুরে দশ দিগন্তে রটিয়ে দিন-
‘সকল মানুষ, বৃক্ষ-লতাগুল্ম, পশুপাশি শান্তিতে থাকুক। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | নিজের ঘরের দেয়ালের কানে চাপা কণ্ঠস্বরে
প্রার্থী হই অতিশয় দীন কোনো ব্যক্তির মতন।
কী-যে চাই তার কাছে নতজানু যখন তখন
ব্যর্থতার খোয়ারি-ঠেকানো যত কাঙাল প্রহরে
জানি না, কেবল হৃদয়ের চোখ থেকে রক্ত ঝরে।
দুবাহু এগিয়ে যায় দেয়ালের দিকে, মায়াবন
ইট-বালি ফুড়ে জেগে ওঠে, তোমার যুগল স্তন
স্বপ্নিল চোখের মতো উন্মীলিত সিমেন্টের স্তরে।তোমার স্তনাভা দেয়ালের কাছে নিয়ত আমাকে
নিয়ে যায়, বিশেষত মধ্যরাতে। কখনো কখনো,
মনে হয়, দেয়াল তোমার শরীরের দীপ্ত ত্বক।
অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায় স্বপ্ন থাকে
পড়ে ঘরময়, যেন ভাঙা বাবুইয়ের বাসা, ঘন
কুয়াশায় নিমীলিত আকাঙ্ক্ষার সমাধি-ফলক। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বসে, শুয়ে দাঁড়িয়ে,-কিছুতেই
না আমার সুখ, না স্বস্তি।রেস্তোরাঁয় চিকেন কাটলেট অর্ডার দিয়ে অথবা বাসস্টপে
দাঁড়িয়ে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে গাছ থেকে
পাতা খসে-যাওয়া কিংবা
ঝালমুড়িঅলার তৎপরতা দেখতে দেখতে
আমি ছটফট করি।
মনে আমার চরকি; চাদ্দিকে এই
ঘোরাঘুরি আমার সময়কে খায়, আমাকেও
খায়। সুতোহীন এক রঙিন ঘুড়ি
আকাশে দুলতে দুলতে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়
আর তাকে ধরার জন্যে ছুটতে থাকি অবুঝ
বালকের মতো। সবুজ ঘাসে লুকানো পাথরে হোঁচট খেয়ে
আমার ঠোঁট থেকে ঝরে রক্ত। তবুও
হুঁশ নেই, চলে হাত বাড়িয়ে অবিরাম ছোটা।না বিত্তের ঝলসানি, না রমনীয় ভালোবাসা,
শুধু এক শব্দ্তৃষ্ণা আমাকে অষ্টপ্রহর
তাড়িয়ে বেড়ায় এদিক থেকে ওদিক।
হাওয়া, গাছের পাতা, রোদের টুকরো
আর পাখির পালক থেকে শব্দ পাওয়ার
আশায় এই বয়সেও ভাষাহীন আমার তুমুল ছটফটানি।হঠাৎ কিছু শব্দ পেয়েও যাই, অথচ শব্দগুলোকে
ঠিকমতো সাজাতে গিয়ে
পণ্ড করে ফেলি বিন্যাসের আলপনা আর
প্রিয়তমা শবের পাশে বসে উস্কো খুস্কো। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | এড়িয়ে পিতার দৃষ্টি যৌবনপ্রত্যুষ দরজায় খিল দিয়ে
কবিতা লিখেছি আমি আর মনে প্রাণে
কবিতাকে করেছি গ্রহণ
পৃথিবীর সর্বোত্তম বস্তু বলে, অথচ জনক
কস্মিনকালে ও জানাননি সমর্থন
আমার এ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের প্রতি। ভরা সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে তিনি
উঁচিয়ে বয়স্ক ছড়ি তাঁর
দিয়েছেন তাড়িয়ে বেবাক অলৌকিক
হরিণ এবং পরী ভাড়াটে বাড়ির
সংকীর্ণ চৌহদ্দি থেকে, আমি
অসহায় বন্ধ ঘরে মেরেছি সকালসন্ধ্যা কপালে চাপড়া।জননীকে বোঝাতে চেয়েছি কবিতাই প্রকৃত আবেহায়াত
অস্তিত্বের ব্যাপক খরায়
মা আমার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে গ্রীষ্মের দুপুরে
নিরিবিলি ঢেলেছেন মাটির সুরাই থেকে পানি,
যেমন শৈশবে তিনি আমাকে সাদরে
ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে গৃহকোণে শাণিত বটিতে
কাঁটতেন রান্নাঘরে রুপোলি ইলিশ।বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে দয়িতার কানে কানে, মনে পড়ে,
গোধূলি বেলায়রমনা লেকের ধারে কবিতার পঙ্ক্তিমালা আউড়ে বলেছি-
কবিতা তোমারই মতো অনিবার্য স্বপ্নভূমি আমার জীবনে।
অর্থনীতিকানা তুমি ব’লে সে যুবতী
জ্বলজ্বলে কূটনীতিকের
ঘনিষ্ঠ জীবনলগ্ন হয়ে দিলো পাড়ি মার্কিন মুলুকে।
কারুর পিতাই নয় বস্তুত অমর। তাই পেনসনভোগী
জনক গেলেন পৌছে একদিন মায়াবী স্টেশনে
বিপন্ন সংসার ফেলে হাভাতে আঁধারে;
আমার কলেজ-পলাতক সহোদর রাত জেগে টকটকে
লাল কত আশার অক্ষরেদিলখোলা অজস্র পোস্টার লেখে চোখের আড়ালে,
মাঝে মাঝে জেল খাটে এবং বিবাহযোগ্য বোন
প্রত্যহ শাপান্ত করে উদ্ভিন্ন উজ্জাত যৌবনকে।
আমি নিজে যেন তেন প্রকারেণ চাকরির খোঁজেদিনে
অফিসে অফিসে ঘুরি আনকোরা গোয়েন্দার মতো,
রাতে
পরাবাস্তবের পিঠে তুমুল সওয়ার হয়ে ক্ষিপ্র
বলপেনে
ক্ষণজীবী বসন্তের এবং ফেরারি কোকিলের
জন্যে হা-পিত্যেশ করে ছিমছাম আঠারো মাত্রার
সুঠাম অক্ষরবৃত্তে কত তন্দ্রালু কবিতা লিখি
ঢুল ঢুল চোখে।
সন্ধ্যা নামে, নিরক্ষর সন্ধ্যা নামে শহরের বেল্লিক বস্তিতে।
আমার ভূতলবাসী অস্থির অনুজ আসে খুব
সন্তর্পণে
মায়ের হাতের রান্না চেখে নিতে মাঝে-সাঝে ফের
চকিতে গা-ঢাকা দ্যায় কে জানে কোথায়।
আমার ধৈর্যের বাঁধে ফাটায় সে বোমা বেধড়ক,
গালমন্দ দিই ওকে, বিশেষত যখন অফিসি মহাপ্রভু
আমাকে শুনিয়ে দেন বাছা বাছা স্ল্যাং। ইতোমধ্যে
একটি নিখাদ চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি দৈববলে। বোনটিকে
ফাঁকি দিয়ে মহল্লার মাশাল্লা যুবক
সটকে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। সহোদরা যৌবনের জতুগৃহে
পোড়ে দিনরাত।
আমার জননী তাকে সর্ব্দা রাখেন চোখে চোখে,
পাছে সে গলায় দ্যায় দড়ি কিংবা ঝাঁপ
লাখেরাজ জন্মান্ধ কুয়ায়।কোনো কোনো মধ্যরাতে সঙ্গমান্তে গৃহিণী বলেন
চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সারাটা জীবন যাবে
ভাড়াটে বাড়িতে,আজো তো হলো ছাই নিজের বসতবাড়ি কোনো।
আমি বিদূষক সেজে হাসন রাজার মতো গেয়ে উঠি-
কী ঘর বানামু আমি শূন্যের মাঝার।
যদিও বাসাড়ে আমি জন্মবধি এই দুনিয়ায়,
রোজানা বানাচ্ছি দ্যাখো গায়েবি মহল।আমার অনুজ জপে প্রত্যহ মাও সে-তুঙ আর
পড়ে কৃশকায় চারুবাবুর কেতাব,
যা নিশ্চিত পাইপগানের চেয়ে বেশি অগ্নিউদগীরণকারী।
আমার অনুজ সুকান্তের সংক্রামক প্রেরণায়
নিজেকেই ঠাউরেছে মহান লেনিন।
দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়িয়ে যায়, তবু
কোথাও পাই না খুজে অনুজকে আর।কখনো সখনো আমি কবিসম্মেলনে যাই, নামজাদা সব
কবিদের সঙ্গে মফস্বলী মঞ্চে সদ্য-লেখা পদ্য পাঠ করি।
খদ্দরের পুরোনো পাঞ্জাবি
উড়ন্ত ঘোড়ার ডানা; বিবর্ণ স্যাণ্ডেল
হোলি গ্রেল; কিছুক্ষণ শব্দের নিজস্ব ইন্দ্রজালে
পিঠচাপড়ানি পেয়ে, দিশি মাল টেনে
ভুলে থাকি বাস্তবের কচ্ছপ-কামড়
তোতাপাখি বিবেক ছোলার লোভে সকল সময়
নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে থাকে।
আমার বাঁদিকে বসে চোখের পিচুঁটি মোছে আর
হাই তোলে বারো বছরের স্বাধীনতা।
ইদানীং প্রায়শই পড়ি অনুজের বিস্ফোরক
পুরোনো ডায়েরি,
দাঁড়া-বার-করা হিংস্র পোকার মতন
ভাবনা মগযে ঘোরে। হতচ্ছাড়া জীবনকে কিছুতে পারি না
নিয়ে যেতে অন্য কোনো বাঁকে
শুধু পালটে দিই, ক্রমাগত দিতে থাকি
আমার নিজের কবিতার কিছু শব্দ রাগে, চরম ঘেন্নায়। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | শুভবাদী রোদ চুমো খাচ্ছে লতাগুল্মে ঢাকা এই
রেস্তোরাঁকে, প্রাণে
পুরনো বৈভব নিয়ে বসে আছি, ছোট
টেবিলের ওপারে তরুণী, একা গায়ে
টোমাটো রঙের পুলওভারের প্রগাঢ় মমতা।
সমুখে স্যালাড, বিফ স্টেক,
সোনালি সুরার পাত্রে ঠোঁট।
কখনও দেখছি তাকে বিদেশী সংকোচে, কখনও বা নিসর্গকে।একটু একটু নিচ্ছি স্বাদ
বাদামি রুটির,
মুখের ভেতর গলে টাটকা মাখন;
উড়ন্ত বেগনি পোকা তার সোনালি আঙুলের বসে
খেলা করে, কিছুক্ষণ ডগালগ্ন থাকে, যেন
হয়েছে মাতাল তন্বী ত্বকের উত্তাপে।
-এ কিসের ছায়া মাঝে-মধ্যে দুলে ওঠে।
মৃদু প্রবাধন-ধন্য মুখে?
পরা বাক্ পাক খায় বারবার মনের ভেতর। মনে হয়
এরকম বসে-থাকা, ত্র্যানিমার মুখোমুখি, বহু
শতাব্দী আগেও ছিল। ওর লাল বুটে
ঘাসের সবুজ স্মৃতি লুটোপুটি খায়, যাত্রী নিয়ে দূরে বাস চলে যায়।একদা এখানে এই পুরনো মহলে আসতেন পুশকিন,
বাতাসের গুঞ্জরণময় ছায়াবীথি পেতো কবি দৃষ্টি; তিনি
হেঁটে যেতে-যেতে
হেমন্ত বিকেলে
চকিতে পেতেন খুঁজে কবিতার পংক্তিমালা
চৈতন্যের ষড়জে নিখাদে।
গাছের শিকড়গুলি সর্পিল আবেগে
তাকেই জড়াতে চায় রক্তে যার আফ্রিকার গহন ঝংকার।
বেলা বাড়ে, চুল ওড়ে মৃদু;
অচিহ্নিত বেদনায় ছায়া জমে মনে, রেনকোট নিই
কাঠের চাকতি জমা দিয়ে
প্রৌঢ় সজ্জনের কাছে। কারুকে বিদায়
না বলে ট্যাক্সিতে উঠে, ফিরে যাই মাইল-মাইল
দূরে নক্ষত্রের নীড়-ছোঁওয়া হোটেলের কামরায়।
কালো কফি খেতে খেতে ভাবি
উড়ন্ত বেগনি পোকা, রোদ-লাগা গোলাপি আঙুল,
কাঠের রেলিঙে ঝুঁকে-থাকা ডগার লতার কথা।
ক্রীড়াপরায়ণ পোকাটির প্রতি তার
প্রসন্ন দৃষ্টির মায়া বিলিয়ে কী কথা
ভাবছিল সেই মেয়ে? কারো সঙ্গে অভিমান করে
এসেছে একলা চলে? নাকি যে আসবে বলে কথা
দিয়েছিল, সে মেট্রোর টিকিট কাটেনি ভুলক্রমে?ঝর্নার পানির মতো সময় গড়িয়ে যাবে, ক্রমাগত ঘোলা
হবে জল দশ দিকে, রাশি রাশি মাছ
কোথায় হারিয়ে যাবে ব্যাপক দূষণে।
বিস্মৃতির ধূসর ডাস্টার নির্বিকার
নিমেষে ফেলবে মুছে অনেক কিছুই। ভুলব না
সেই কবে দূর দেশে শুভবাদী রোদ
চুমো খেয়েছিল
লতাগুল্ম ঢাকা রেস্তোরাঁকে, একটি বেগনি পোকা
খেলা করেছিল সরু গোলাপি আঙুলে।
লাল বুটলগ্ন কচি ঘাসের ডগাকে ভুলব না কোনোদিন। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে,
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হল গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন-তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্নের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহাবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকো চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্ধিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে শরিক হবো না, কারো কোনো
প্ররোচনা কিংবা ছলাকলা
পারবে না আমাকে নামাতে সেই হুড়োহুড়ি, সেই পড়ি-মরি
নির্লজ্জ খেলায়। হেঁটে যাবো
একান্ত নির্জন প্রতিযোগীহীন পথে। ভোলা মন যা চাইবে
যখন, করবো সেই কাজ মহানন্দে তখন-কখনো
বটের ছায়ার বসে দেখবো পাখির
কোমল প্রণয়লীলা, কখনো-বা ভাসমান দেঘ।না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে নেই। যে উদাস
বাউলের ডেরা
অন্তরে আমার, সে আমাকে একতারা
বাজিয়ে শোনাবে গীতিমালা, দেবে তুলে
আমার ইচ্ছুক হাতে অরূপ ছিলিম, চতুর্দিকে
চকিতে উঠবে নেচে আরশি নগর। কে আমার
মনের মানুষ ব’লে খোলা পথে হেঁটে যাবো একা,
ব্যাকুল ডাকবো তারে, পাবো না উত্তর। একতারা
বেজে চলে পথের ধুলোয় আর গাছের পাতায়, মেঘলোকে;
শহুরে বাউল হাঁটে একাকী নিজের পথে, যেতে হবে হেঁটে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | একদিন সন্ধ্যেবেলা ফ্ল্যাটে ফিরে দেখি
থমকে-দাঁড়ানো অন্ধকার বারান্দায়
দাঁড়ের সবুজ টিয়ে পাখিটার ঘাড় কী নিখুঁত
মটকে পালিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, তাকে খুব চেনা চেনা
লাগল আমার। কিছুদিন
শুধু সবুজাভ ছোপ চারপাশে বারংবার ভেসে
বেড়াল আমাকে ঘিরে। খুন হয়ে যাওয়া টিয়েটার
কথা ভেবে মন ভারি খারাপ থাকল কিছুকাল।
এই তো সেদিন
মাঝ রাত্তিরের বুক শিল্পিত আঁচড়ে চিরে চিরে
বিলায়েত খান
ক্যাসেটে নিশুত দরবারি কানাড়া হচ্ছেন ক্রমে,
হঠাৎ আমার পোষা বেড়ালের, যে আমার
চেয়ারে শয্যায় আর কখনো সখনো
লেখার টেবিলে ঘুমে থাকে, কান্না শুনে
ছুটে গিয়ে দেখি গলা টিপে আক্রোশে মারছে একজন
লোক, হাতে নাতে তাকে ধরে ফেলতেই
সে তাকাল আমার চোখের দিকে, ওর চোখ দুটো
দেখে ভয়ে পেছিয়ে গেলাম
তিন হাত। লোকটা নিহত বেড়ালের
শব ঝুল বারান্দায় ফেলে
চলে গেল অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে। বাষ্পাকুল চোখে
সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকলাম
উঠোনে মাটির নিচে নিষ্প্রাণ বেড়ালটিকে
গুপ্তধনের মতন চুপিসারে
গচ্ছিত রাখার পর।
অন্যদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ-বিদেশের
কবিতার বইগুলো দিয়ে
সাজালো জ্বলন্ত চিতা সেই একই লোক। অসহায় চক্ষুদ্বয়
অসহ্য আটকে থাকে ভস্মীভূত অক্ষরমালার দিকে, যেন
অপরূপ একটি সভ্যতা লুপ্ত হলো
আমার চোখের নিচে ঘটা করে। কেমন নিশ্চুপ বসে থাকি
পোড়া গন্ধময়
একলা ঘরের মধ্যে অতিশয় বিস্ফোরিত চোখে।আকাশ যাচ্ছিল ভেসে চাঁদের যৌবনে আর আমি
ছিলাম নিবিষ্ট ঝুঁকে লেখার টেবিলে।
অকস্মাৎ অমাবস্যা গ্রাস
করে আকাশকে, সে লোকটা
বলা কওয়া নেই
ঘরে ঢুকে আমার নিজস্ব কবিতার খাতা কেড়ে
নিয়ে কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে
সবগুলো পাতা, তার ক্রূর ক্রিয়াপরায়ণ হাত
থেকে খাতা ছিনিয়ে নেয়ার
সাহস হলো না, আমি শুধু নির্বাসিত
কবির মতন
অশ্রুপাত করি ধু-ধু বিদেশ বিভুঁইয়ে।পড়েছি ভীষণ ধন্দে লোকটাকে নিয়ে; একে একে
আমার সকল প্রিয় বস্তু নষ্ট করে
সে এখন ভয়ানক উল্লাসে প্রমত্ত আর আমি নামহীন
আতঙ্কে সেঁধিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর ক্রমাগত। মনে হয়,
যে কোনো মুহূর্তে এসে লোকটা আমার
মুখের ভেতর ঠেসে দেবে অসংখ্য ঘুমের বড়ি। বড় ভয়ে
ভয়ে থাকি, হে দীপিতা, যদি
আমাদের আর দেখা না হয় কখনো কোনো দিন।
পদধ্বনি শুনি, কার? লোকটা কি আসছে আবার? রোমকূপ
কাঁটা হয়; অথচ নিজেই আমি বানিয়েছি তাকে। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | [সালেহ চৌধুরী বন্ধুবরেষু]মধ্যরাতে একা রিক্শা থেকে নেমে দেখি, কী আশ্চর্য,
মুখিয়ে রয়েছে চির চেনা বাড়ি, যেন
আমাকে চেনে না, যেন তার বাসিন্দার ঘ্রাণ নেই
আমার শরীরে।
দরজার কড়া বাজাবার
সাহস হলো না, কিছুক্ষণ নিজের বাসার কাছে চুপচাপ
অচেনা লোকের মতো অস্বস্তির ঘামে
নেয়ে উঠি, একবার সরে যাই, ফিরে আসি ফের।
আমার এ আচরণ
নিজের কাছেই কী রকম খাপছাড়া
লাগে, দেখি অকস্মাৎ মাটি ফুঁড়ে আঁধারে লাফিয়ে ওঠে তিন
মাথা-অলা নরকের দ্বারের কুকুর।
চোখের পাতার স্তূপ থেকে বাহু তুলেউঠে আসে একটি কুমারী,
তারপর প্রবাল রঙের শাড়ি খুলে হেঁটে হেঁটে চলে যায়
ধারারো নখের ঝোপঝাড়ে।ক্ষুধারও আঙুল আছে, আছে নোংরা নখ,
যা উপড়ে আনে নাড়িভুঁড়ি, বলে তিনজন ঢ্যাঙা, প্রায় নাঙা,
ভিখারী ছায়ার মতো দাঁড়ায় আমার
কাছ ঘেঁষে, মাথা তোলে নরকের দ্বারের কুকুর।বাড়িটার চোখ ফেটে পানি পড়ে, রক্ত ঝরে, বুড়ো
ভিখারীরা রক্ত চেটে খায়,
কে যেন বিছিয়ে দ্যায় পারস্য গালিচা,
গালিচায় হেঁটে যেতে গিয়ে অন্ধ পাখির ধরনের উড়ে যাই।
(অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | সত্যি বলতে কী বেশ কিছুদিন থেকে
রাতে ঠিক মতো
ঘুমোতে পারিনে। বালিশে
মাথা রাখলেই কী সব আজব
ছবি ভেসে ওঠে চোখের সম্মুখে,
বিভিন্ন হাতিয়ার নাচতে থাকে
আমার চারদিকে, জল্লাদের চিৎকারে
কান ফেটে যেতে চায়, চোখ বুজে ফেলিজল্লাদ কি কাউকে হুকুম দিচ্ছে আমাকে
ধরে আনার জন্য? হয়তো;
আমার বুক ধুকধুক করতে থাকে এবং
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি বাঁচা মরার দোটানায়
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষৎ গুলিয়ে ফেলি।
বিশ বছর আগেকার এক বিকেলবেলার
দৃশ্য ভেসে ওঠে স্মৃতিতে, একজন বিষণ্ন তরুণীকে
দেখতে পাই আমার বেষ্টনীতে।অকস্মাৎ এক জনসভায় দেখি আমাকে
বক্তৃতাপ্রবণ, আমার বক্তব্য হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে
নাকি শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করছে বুঝতে
পারার আগেই শুরু হয় বেজায় হট্রগোল
পুলিশের লাঠির সারি হামলায় মাতে বেধড়ক
আমি কি আহত হয়ে ধুলোয় লুটিয়ে কাতরাচ্ছি বেজায়।
বহুদিন পর নিজেকে দেখতে পাই এক স্মরণসভায়
এ কার স্মরণসভা, অন্য কারও নাকি ভাঙাচোরা আমার? (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ‘আচ্ছা মানুষ তো ভাই আপনি, ভোরের
সূর্য পশ্চিমের আসমানে বুড়ো মানুষের মতো
ধুঁকছে, অথচ চুপচাপ বসে আছেন ঘরের
দরজার খিল এঁটে। দুপুরের আগেই আমার
দোকানে যাবেন বলে কথা ছিল আপনার। ঠিক বলুন তো
পাণ্ডুলিপি তৈরি নাকি আজও ফিরে যেতে হবে শূন্য হাতে?’এসব কী বলছেন আপনি, সাহেব? কে আপনি? কার কী-বা
পাণ্ডলিপি, এসব জানি না কিছু। তা ছাড়া আমি তো
আপনাকে কখনও দেখিনি কোনও কালে। সব কিছু
ভোজবাজি বলে মনে হচ্ছে। আপনি নিশ্চিত ভুল
জায়গায় এসেছেন, আপনার অভীষ্ট মানুষ নই আমি;
আপনাকে ভিন্ন কোনও দোরের কলিংবেলে ধ্বনি তুলতেই হবে
বাঁচা গেল। আমি কি লেখক কোনও? নইলে কেন সম্পূর্ণ অচেনা
একজন পাণ্ডুলিপি করে দাবি আমার নিকট? ভদ্রলোক
ষোলআনা প্রকাশক বলেই হয়েছে মনে। ভ্রমবশত আমার
উদ্দেশেই অবেলায় হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন এখানে।
চিঠি আর আবেদনপত্র ছাড়া অন্য কিছু
কখনও লিখিনি, তবে কেন পাণ্ডুলিপির চাহিদা এত?হায়, এ কেমন এলোমেলো ঠেকছে বেবাক কিছু; উল্টোপাল্টো
চতুর্দিকে; ফাঁকা, সব কিছু ফাঁকা, বড় ধুধু স্মৃতির এলাকা।
একটি বিশাল, ভয়ঙ্কর পশু গিলে খাচ্ছে আকাশ, জমিন।
অকস্মাৎ প্রশ্ন জাগে মনে, কখনও কি
সুদূর অতীতে কোনও কালে আমার খাতার শূন্য পাতাগুলি
উঠত কি ভরে নানা শব্দে কলমের চুম্বনের ফুল ঝরে?আমি কি বিস্মৃতকালে রাত জেগে লিখেছি ঝাঁঝালো দলছুট
উপন্যাস? আমার লেখনী থেকে হয়েছে কি নিঃসৃত একদা
পাঠকনন্দিত কবিতার পঙ্ক্তিমালা? এই আমি
ছিলাম কি কাফে আর বইপাড়ার আড্ডার
শানানো জিভের মুখরোচক খোরাক? দিন যায়, রাত যায়, ভাবীকালে
এই অধমের কোনও বই থাকবে কি কাব্যপ্রেমী কারও হাতে? |
শামসুর রাহমান | রূপক | একজন কাকের কাহিনী এ শহরে অনেকেই
জানে, গাঁও গেরামেও তার কিছু পরিচিতি আছে
বলে শুনি একদা প্রভাবশালী এই কাক খুব
সাধ করে একটি কোকিল হতে চেয়েছিল, ফলে
চাতুর্য শানিয়ে বোকা বানিয়ে গায়ক পাখিদের
সহজে তাদের ঝানু পুরোহিত সেজে গেলো আর
তার তাঁবেদারি করবার কোকিলের অনটন
হলো না কোথাও, দেখি তার জমজমাট প্রসার।অথচ কাকের খাসলত আগের মতোই থাকে
নোংরা ঘাঁটে, আঁস্তাকুড়ে ঘোরে দিনরাত
ভীষণ কর্কশ ডাকে যথারীতি; প্রতিপত্তি কমে
যাওয়ার দরুণ আজ কোকিল, দোয়েল শ্যামা পাখি,-
যাকে পায় তাকেই ঠোকর মারে তীব্র হিংস্রতায়;
তবুও হয় না বন্ধ সুরমও পাখিদের গান। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | যদি চাও, ভরে দিতে পারি এই ভোরের অঞ্জলি
গল্পের অজস্র ফুলে। শোনো বাঘ-ভাল্লুকের নয়,
অথবা পরীরও নয়, চেনা মানুষেই গল্প বলি।
করবো না নামোল্লেখ কিংবা করবো না নয় ছয়
ঘটনাবলিকে সত্যি। একরত্তি মেয়ে তুমি, তাই
বুঝরে না কাহিনীর সন্ধ্যাভাষা। একটি পুরুষজীয়ন কাঠির স্পর্শে চেয়েছিলো জাগাতে হৃদয়
মহিলার স্বপ্নাবেশে। বাস্তবের কর্কশ বুরুশ
খানিক রগড়ে দিলো তাকে, বাসনার ছিনতাই
দেখলো স্বচক্ষে, সে মহিলা, মানে, তোমার জননী
স্যুইচ টেপেনি তার ঘরে কিংবা খাবার টেবিল
সাজায়নি কোনোদিন। তার অস্তিত্বের রাঙা ধ্বনি
অন্যত্র পেলব বাজে, তুমি জানো। দিয়েছে সে খিল
একদা-র কপাটে নিপুণ; শোনো, তুমি প্রজাপতি
হ’য়ে ঘোরো, পুতুলের বিয়ে দাও, চালিয়ে কুরুশ
ইচ্ছেমতো তুলো ফুল যৌবনে রুমালে, নেই ক্ষতি
কারুর হৃদয়ে জ্বেলে তারাবাতি, সাজিয়ে নহবৎ
নাড়িও না ভুলে তুমি আরেক জনের ঘরে নথ। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কস্মিনকালেও অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই।
না ছোরা, না ভোজালি, না সড়কি না বল্লম
না তলোয়ার না বন্দুক-
কোনা কিছুরই প্রয়োজন নেই আমার।
আমি মারমুখো কোনো লোক নই।
বালক বয়সেও আমি কোনো ফড়িং-এর
পাখনা ছিঁড়িনি,
প্রজাপতিকে আলপিন দিয়ে
আটকে রাখিনি কাগজে।
কখনো উড়ন্ত কিংবা গাছের ডালে বসে-থাকা
কোনো পাখির প্রতি তাক করিনি
বন্দুকের চকচকে নল।ছায়াময় আশ্রয়ে সময়-পোহানো
পাখি,
বিকেলের আবীর মেখে দাঁড়ানো তন্বীর মতো
গাছ,
পলায়নপর সূর্যের চুমো-খাওয়া
নদী,
ইতস্তত ছড়িয়ে-থাকা খুচরো সিকি আধুলির মতো
তারা,
প্রত্যেকেই নিজস্ব ভাষায়
গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে শান্তির পাঁচালিতে।
দুই আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
আমি কান পাতি গোলাপ আর চন্দনের ব্রতকথায়।
যতদূর মনে করতে পারি,
কোনোদিন আমার ওষ্ঠ অস্ত্রবন্দনায়
স্ফুরিত হয়নি।
কিন্তু আমার ঘরে কেউ আগুন দিতে এলে,
আমার ভায়ের বুক কেউ বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিলে,
আমার বোনের রওশন চৌকি
কেউ তছনছ করে দিতে এলে,
নিরস্ত্র আমি নিমেষে হয়ে উঠি দুরন্ত লড়াকু।আমার লড়াইয়ের রীতি
নদীর ফেরীর মতো; ফুল আর সুরের মতো
পবিত্র।
আমার কোমর কালো বেল্টে শোভিত হোক আর নাই হোক,
শেষ অব্দি লড়ে যাবো
অস্ত্রের প্রশ্রয়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন।
না ছোরা, না ভোজালি, সড়কি না বল্লম,
না তলোয়ার না বন্দুক-
কিছুই নেই আমার,
এই আমি নিজেই আমার অস্ত্র। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সে যেন আমাকে সদা ছায়ার ধরনে সেঁটে থাকে,
জানি না কিসের জন্যে। তার এই কাণ্ড
আমাকে নিক্ষেপ করে বিরক্তির বেড়াজালে, কিন্তু
কিছুতেই পাই না রেহাই।কখনও কখনও আমি চুল ছিঁড়ে নিজের মাথার
স্বস্তি পেতে চাই, কিন্তু সেই নটবর
অদ্ভুত হাসির বৃষ্টি ছিটিয়ে আমার মনে আরও
বেশি বিরক্তির ঢিল ছুড়ে দেয় শিকারের দেকে।অবশ্য করি না ত্যাগ শেষতক আমার নির্দিষ্ট
কাজ, দিব্যি চালাতেই থাকি কলমের
কাজ, যতক্ষণ ঠিক শব্দ বসে না যথার্থ স্থানে,
মাথায় চলতে থাকে নানাবিধ শব্দের জরুরি আসা-যাওয়া।জানা আছে জ্ঞানীদের নানা বাণী, যেসব কবির
কোনও-কোনও কাজে উপকারী-যেগুলির
প্রয়োগে নতুন পথ খুলে যেতে পারে
এবং সে-পথে হেঁটে যেতে-যেতে নয়া পথ গ’ড়ে ওঠে।একদিন যে-ভাবনা ঠিক পথে জ্বলজ্বলে ক’রে তোলা ঢের
মুশকিল ছিল, সার্থকের হাত ধরা
ছিল যেন অসাধারণ, কবির কল্পনার মায়াবিনী! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ফিরে যাবো? কেন ফিরে যাবো বারবার?
জানি সিংহদ্বার
পেরুলেই পেয়ে যাবো আকাঙ্ক্ষিত সব
উপচার, যার জন্যে ভীষণের স্তব
করেছি সকালসন্ধ্যা, পেরিয়েছি ঝড়মত্ত নদী, কতো সিঁড়ি,
রক্তাপ্লুত, বারংবার নেমেছি খনিতে। আজো ফিরি
পথে পথে কেইনের মতো। ফিরে যাবো? প্রহরীর
রক্তচক্ষু দেখে ফিরে যাবো? তুমি তবুও বধির
হ’য়ে থাকবে সর্বক্ষণ? ডাকবে না সেখানে, যেখানে
আমার ব্যাকুল পদচ্ছাপ পড়েছিলো স্বপ্নে, মানে
অলৌকিক অভ্যন্তরে। এই রুদ্ধ সিংহদ্বার থেকে
হতাশায় ভগ্নরথ ফেলে রুক্ষ ক্লান্ত মুখ ঢেকে
গেছেন আমার পিতামহগণ ফিরে। আমার শপথ,
প্রাপ্য ছাড়া আমিতো যাবো না ফিরে, থামাবো না রথ। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কখনো কখনো সত্য ঘটনা গল্পের, বলা যায়,
চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্যজনক
মনে হয়। এই তো ইঞ্জিন এসে চকিতে নিছক
উন্মাদের মতো
আচরণ করে দিব্যি বসে রইল; শত
সাধ্য সাধনার
পরেও সেখান থেকে এতটুকু নড়বার নাম
করল না। গোধূলিতে সতেজ হাওয়ার
আরাম পাবার বাসনায় প্ল্যাটফর্মে নামলাম
আর ক’জনের মতো। কী নীরব চতুর্দিকে, শুধু
একটি দুটি কণ্ঠস্বর, গলায় গ্রামীণ টান,
শোনা যায় ইতস্তত, ধু-ধু
মাঠ আর অদূরে ডালিম গাছ, ট্রাঞ্জিস্টারে লালনের গান।কী অবাক কাণ্ড, মনে হয়
বহুদিন পরে ফের তোমাকে ট্রেনের জানালায়
দেখলাম কী সুন্দর, জীবন এ-ও এক পরম বিস্ময়।
যাব কি যাব না ছুটে, এই দোটানায়
মুহূর্ত গড়িয়ে যায়, মাথার ওপরে
নীড়গামী পাখি ওড়ে।
ফুরফুরে কোমল হাওয়া, বহু স্মৃতি পাড়ি-দেয়া, ছুটে যায় তোমার উদ্দেশে
ক্লাস থেকে ছুটি পাওয়া বালকের মতো। তুমি হেসে
তাকালে সে কার দিকে? তুমিই তো ঠিক
ট্রেনের জানালা ঘেঁষে বসে আছে? নাকি অন্য কেউ?
অমন দিঘিতে ভোরবেলার ঝিলিক-
দেয়া চোখ আর কত হতে পারে? আমার হৃদয়ে এই ঢেউ
অপর কাউকে দেখে জাগতে পারে না। নাকি পারে?
পা বাড়াতে গিয়ে শুনি তোমার ট্রেনের গার্ড বাঁশি
বাজায় হঠাৎ। ট্রেন ছাড়ে,
দূরীভূত মূর্তির মতোই স্থাণু আমি; রাশি রাশি
ধোঁয়া প্ল্যাটফর্ম অন্ধকার করে ওড়ে।
তুমিই কি ছিলে ট্রেনে? কিছুতেই কাটে না ধন্দ। মনুষ্যজীবন
এরকমই; ভাগ্যিস আমার ট্রেন করেছিল বিকারের ঘোরে
উন্মাদের মতো আচরণ। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কোথায় মনের মুক্তি? বহুদূর জনহীন দ্বীপে
অথবা পর্বতশৃঙ্গে, বিশাল অরণ্যে নাকি ধুধু
প্রান্তরের মধ্যপথে? নিসর্গের খুব কাছাকাছি
গেছি বার-বার, মনে লেগেছে উদার হাওয়া আর
আমার সমগ্র সত্তা হয়েছে সবুজ, লাল নীল
ফিরোজা বেগনি, হলদে ঋতুতে ঋতুতে। কখনোবা
গ্রন্থের অক্ষরদ্বীপে ক্রূশোর মতন হেঁটে হেঁটে
পেয়ে গেছি কী উম্মুক্ত অনাক্রমণীয় বাসভূমি।কখনো আবার কোন নান্দনিক চেতনায় ভাবি
শিল্পেই মনের মুক্তি। বুঝি তাই যেখানে তুলির
সখ্য আর মোহন যুগলবন্দী বাটালি ছেনীর
যেখানে সংগীত হয় অন্দ্রধনু বিস্তারে বিস্তারে
সেখানেই স্বস্তি খুঁজি। আবার কখনো মনে হয়
প্রকৃত মনের মুক্তি দয়িতার সান্নিধ্যে বিস্তৃত। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | যে-কোনো দিনেরই মতো তিমিরের নাড়ী-ছেঁড়া আলো
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। একটি তরুণী
লাল নীল ঘুড়ি
ছেড়ে দেয় বায়ু স্তরে; বিকেলে চায়ের কাপে প্রফুল্ল চুমুক,
ঘোরানো সিঁড়িতে গাঢ়-মিহি স্বরে কথোপকথন,
ছাদের ওপারে ছিল জ্বলজ্বলে ডাগর বেলুন,
চাঁদ বলি তাকে। কবি তাঁর
শব্দের ঝর্ণাকে ব্যালে শিক্ষকের ধরনে নিপুণ
পরিচালনায়
মোহন গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এখানে আগুন নিয়ে
দ্যুতি, বলে তাঁকে গাছপালা,
নীড়ে-ফেরা পাখি, অস্তরাগময় শহরে কলোনি।অকস্মাৎ চতুদিকে দৃষ্টি-অন্ধ করা কী বিপুল
উদ্ভাসন; মাটিতে আগুন,
লতাগুল্ম, গাছে-গাছে গোলাপের, চামেলীর পরাগে আগুন,
পাথরে-পাথরে লকলকে
জিভের মতন জ্বলে আগ্রাসী আগুন,
পশুপাখি, মানুষের ভেতরে আগুন, অন্তরীক্ষে,
জলের ওপরে আর ভেতরে আগুন জ্বলে; যেন এ-শহর
পরেছে চকিতে উরু, জানু, বুক, মাথা
জুড়ে আগুনের শাড়ি। মর্ত্যভূমি বজ্ররশ্মিজালে
বন্দি হয়ে চোখের পলকে রূপান্তরে কী উত্তপ্ত ভস্মাধার।সাইরেন বড় মূক, ঘোষণা করার মতো কোনো
কণ্ঠস্বর নেই
এখন কোথাও। সংখ্যাহীন ঝলসানো গোরু-ঘোড়া
মাঠে কি গোয়ালে, আস্তাবলে পড়ে আছে
ইতস্তত ভীষণ নিষ্প্রাণ, প্রভুভক্ত কুকুরের ক্ষয়ে-যাওয়া
নিঃস্পন্দ শরীর সমর্পিত
নগ্ন বারান্দায় নৈবেদ্যের মতো। নিস্তব্ধ বসন্ত, পাখিদের
অজস্র কংকাল নগ্ন গাছে-গাছে। এমনকি পাথরের নিচে যতো
প্রাণী টিকে থাকে প্রতিহিংসার মতো,
তারাও এখন চিহ্নহীন।মাটি আর দেবে না কিছুই। কোনোখানে এক ফোঁটা
জল নেই ভয়ানক দূষণ ব্যতীত। ফলমূল
কোথাও নির্দোষ নেই আর। খাদ্য আছে শস্যাগারে,
অথচ ভক্ষণযোগ্য নয় এককণা।তেজস্ক্রিয় ভস্মের ঘোমটা-টানা পৃথিবীর ঠোঁটে,
রোদ চুমো খায় পুনরায়। কিন্তু এই রোদ নিয়ে
উৎসব করার মতো কোনো প্রাণী নেই।
দশ দিকে। মহাজন অথবা ঘাতক, গৃহী কিংবা
ঘরছাড়া চিরপলাতক, জুয়াড়ী অথবা নববিলাসের
টানে সাতঘাট জল-খাওয়া বাবু, দূরন্ত সাহেব,
অথবা পটের বিবি, বেশ্যার দালাল,
তুখোড় দোকানদার অথবা খদ্দের,
ট্রাফিক পুলিশ কিংবা ধাবমান যান,
মুর্দা কিংবা মুর্দাফরাস কারুরই
নামগন্ধ নেই।
যোজন যোজনব্যাপী ধুধু চরাচরে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে
থরে থরে সাজানো কৌটায়,
নানান রঙের জামা কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আর
কার্পেটে পাপোষে মৃত্যু বুঁদ হয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে
ঠোঁট চাটে টুপ ভুজঙ্গ মৃত্যু, যেন
নিজেকেই আকণ্ঠ করবে পান। চতুর্দিকে ক্রুর দাবদাহ,
বস্তুত পৃথিবী পঞ্চতপা।হঠাৎ ভূতল থেকে কেউ
উঠে আসে হামাগুড়ি দিয়ে কায়ক্লেশে আদিম শিশুর মতো,
পারে না তাকাতে ঝলসিত পৃথিবীর দিকে, চোখ
তুলতেই দ্যাখে একজন এক টুকরো আনন্দের মতো ফল
বাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রতি রমণীয় ভঙ্গিমায়।
নারী আর পুরুষের তীব্র থরো থরো
আলিঙ্গনে আদিগন্ত নগ্ন স্তব্ধতায়
আনন্দ-বেদনা জাত কবিতার মতো হেসে ওঠে ভালোবাসা। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | মদিরা করিনি স্পর্শ, অথচ মাতাল হ’য়ে আছি
দিনরাত; নিত্য কুৎসাকারীদের জিভের খোরাক
আমি, কেউ কেউ ক্রোধে আমাকে পুড়িয়ে করে খাক।
আমার করোটি জুড়ে কবিতার সোনালী মৌমাছি
প্রায়শ গুঞ্জন তোলে; অচিন পাখিরা নাচানাচি
করে হৃৎবাগানে আমার। গূঢ় রহস্যের ডাক
নিশীথে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘ভরা থাক
তোমার প্রেমের পাত্র। যদি থাকে, তাহ’লেই বাঁচি!মাতাল, মাতাল আমি সুনিশ্চিত। কারো অপবাদ
দেবো না উড়িয়ে হেসে, তবে বলি দৃঢ় কণ্ঠস্বরে-
বিত্তের লালসা নয়, চপল খ্যাতির মোহ নয়,
প্রতাপশালীর সীমাহীন তীব্র ক্ষমতার সাধ
কিংবা ধর্মান্ধতা নয়, সত্যি আমাকে মাতাল করে
প্রকৃত কবিতা আর সুপ্রিয়ার প্রগাঢ় প্রণয়। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কোথাও ছিল না বৃষ্টিধারা, এ আমার শহরের
অশ্রুপাত; কেঁদে কেঁদে শহরের চোখ দু’টো লাল
আর অতিশয় ফোলা কেন
পারে না বলতে কেউ। কেন তার বুক ঠেলে এত
কান্না ওঠে প্রহরে প্রহতে
এ শহর নিজেও জানে না। আমি শুধু কবিতায়
কিছু অশ্রুকণা জড়ো করি অবেলায় ছোট ঘরে
অরক্ষিত, একা।কখন জানালা দিয়ে প্রজাপতি ঘরে ঢুকে পড়ে
ফুলের পাপড়ির মতো, বসে
আমার গ্রীবায়, যেন সে অশ্রয়প্রার্থী, অসহায়,
নিজেকে বাঁচাতে চায় নিপীড়ন থেকে। এখন সে
কম্পমান, যেমন চারার পাতা দুরন্ত হাওয়ায়।
আমি কি পারব দিতে ওকে বরাভয়?
লুকিয়ে রাখব তাকে স্বপ্নের ভেতর,
আমার নিমগ্ন কবিতার ক্যামোফ্লোজে?যা বলি বিশ্বাস করো-ফুরফুরে চড়ুই অথবা
মাছরাঙা, নিভৃত কোকিল,
দ্যুতিময় মাছ, বৃক্ষলতা, ফলমূল, ফুল
এখন কেউই নিরাপদ নয় আর।যখন বয়স ছিল উনিশ কি বিশ,
তখন থেকেই আমি লিখছি কবিতা
প্রায় ভূতগ্রস্ততায়। কত রাত শব্দের সন্ধানে
প্রত্যুষের কাকের আওয়াজে
চমকে উঠেছি, আধা বোঁজা চোখে স্বপ্নের নগ্নতা
লেপ্টে গেছে কতবার। আমার প্রতিটি
কবিতাকে ওরা সারিবদ্ধ কয়েদীর মতো দাঁড়
করিয়ে ফুলেটবিদ্ধ করে আজ গোধূলিবেলায়
আমার আপন ভালবাসা
সজীব ফলের মতো গহন সবুজ পত্রালিতে
আচ্ছাদিত। কখনও কখনও তার চোখে
চোখ রেখে মনে হয়, এই রূপ কোথাও দেখিনি
কোনো কালে; এমনকি আমি তার চলে যাওয়ার ছায়ার
সঙ্গে প্রেমে ম’জে আছি। ‘এইতো এসেছি
ব’লে সে যখন দাঁড়ায় সম্মুখে, তার দিকে
ঘাতকের হাত প্রসারিত দেখে ভয়ে কেঁপে উঠি।ক’দিন বা আছি আর? তারপর অনন্তের পথে
ছায়া হ’য়ে হেঁটে যাওয়া, হেঁটে যাওয়া, শুধু হেঁটে যাওয়া।
অথচ এখনই বন্ধ দরজাটা ঠেলে
ভেতরে আসতে চায় হন্তারক নরকের কুকুরের মতো
দাঁত নখ ভেজাতে শোণিতে। আমার এ শহরের
চোখ ভরা রক্তাশ্রুতে রাত্রিদিন; কে দেবে মুছিয়ে
তার চোখ চুমোর জ্যোৎস্নায়, কে সে? বলতে পারি না।
তার পদধ্বনি বাজল কি আজ দিগন্তের বুকে
গুণীর তানের মতো? আমার শঙ্কিত কাঁধে দৃঢ়তা অর্পণ
ক’রে বলে উঠবে কি, এ শহরে মৃত্যুর উৎসব বাঁচবে না?শহর ঘুমিয়ে ছিল পরিশ্রান্ত শ্রমিকের মতো।
কবি তার সদ্য লেখা কবিতার পঙ্ক্তিমালা জিভে
খেলিয়ে খেলিয়ে বিছানায় গেছে, স্বপ্নের ভেতর
নদীর কিনারে ব’সে গোণে ক’টি সারস নেমেছে
বালুচরে। নতুন কবিতা তাকে দেয় না ঘুমোতে
মাঝে মাঝে, দপ দপ করে চোখে, শিরায় শিরায়।অকস্মাৎ ২৪টি ঘন্টা বেজে ওঠে দেশ জুড়ে,
কবি শোনে ছন্দোময় ভোরে লেখার টেবিলে ব’সে।
সাহস শব্দটি আজ বিশাল হরফে লেখা হ’ল
সারা দেশে, স্বাধীনতা ২৪টি অনিন্দ্য গোলাপ
হ’য়ে ফোটে জনতার হৃদয়ে এবং খলখল
অন্ধকার কেটে চলে নিরন্তর আলোর তরণী।ঘন্টাধ্বনি প্রতিবাদী কবিতার মতো জাগরণী
মহামন্ত্র শোনায়, নিমিষে শহরে চোখ থেকে
ঘুম মুছে যায়, চেয়ে দেখে ২৪টি মুখ তাজা
ভোরবেলাকার মতো। নদীতে পা ধুয়ে কবি হেঁটে
যায় কিয়দ্দূরে নিতে আলোকিত প্রকৃত নিশ্বাস,
২৪ সংখ্যাটি যে ইন্দ্রজালে হ’লে ইতিহাস। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমি কি স্বতন্ত্র্য কেউ? নাকি আগাগোড়া একই ছাঁচে
গড়াপেটা? আ দশজনের প্রতিভু? নিয়ন্ত্রিত
নড়া চড়া, দমদেওয়া বিবর্ণ পুতুল? বুলবুল
ভুলক্রমে জানালার গ্রিলে এস বুকের রেশম
মেলে দিলে আমার নিজের বুক বেশি ধুক ধুক
করবে না? অগোচরে থেকে যাবে সংবাদপত্রের
অন্তরালে জলকন্যা? কবিতা আমাকে অবহেলা
ছুঁড়ে দিয়ে নিছক কর্পূর, তুব উঠবো না কেঁপে?অকাম্য এমন পরিণাম; ঠিক ঠাক দাগ মেপে
ওষুধ খাওয়ার মতো জীবন যাপন খাক হোক
চুল্লীতে, আমার চাই খাদের কিনারে ঝুলে-থাকা
অত্যন্ত বিপজ্জানকভাবে কিংবা দ্রোহী সমুদ্রের
মধ্যখানে,বড় একা, ক্ষুধার করাতে ফালা ফালা,
মৃত্যুর চোয়ালে ব’সে ঝটকায় পাখি টেনে আনা। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | ধরো যদি কাসান্দ্রার মতো কেউ বলতো আমাকে
দারুণ অমোঘ তার কণ্ঠস্বরে, দেয়ালের লেখা
করো পাঠ; হেলেনের মতো রূপ যার, তার দেখা
যদি পাও অকস্মাৎ অবেলায় দৈব দুর্বিপাকে,
কখনো দিও না সাড়া কুহক ছড়ানো তার ডাকে,
তবে কি তোমার অথৈ চোখ, ঠোঁট, স্তনের শিখর
দেখে আমি চোখ বুজে সর্বক্ষণ থাকবো নিথর?
তীব্র স্পর্শে স্পর্শে করবো না ঋদ্ধ আপন সত্তাকে?আমার শিরায় আজ ভাসছে সহস্র রণতরী,
মাংসের প্রাকারে হুহু আর্তনাদ, পুড়ছে মিনার
শতাব্দী শতাব্দী ধরে দুঃস্বপ্নের মতো, নিরুপায়।
তোমার নিকট থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেবে, হায়,
ত্রিলোকে এমন সাধ্য নেই কোনো রূঢ় কাসান্দ্রা।
স্বপ্নের স্মৃতির মতো চোখে তাই চোখ মেলে ধরি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | ছিল না নদী, পাহাড় অথবা প্রান্তর; শস্যের ক্ষেতের
ঢেউ পড়েনি চোখে, বাউলের গান
যায়নি শোনা। এই শহরে শহীদ মিনারে
কতিপয় নারী, যেন শস্যক্ষেত, বিকেলের
নিস্তেজ আলোয়। শহীদ মানিকের মা, একাত্তরের
বীর প্রতীকের মা মাইক্রোফোনের
সামনে দাঁড়ানো এই প্রথমবারের মতো
বক্তার ভূমিকায়। বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা
তাঁর ওষ্ঠে শ্যামা পাখি,
বললেন তিনি মমতার শ্যামল স্বরে-
‘বিশ বছর মা ডাক শুনিনি আমি
তোমরা সবাই আমার সন্তান,
তোমাদের মুখে মা ডাক শুনতে সাধ হয়।নিমিষেই জনসমাবেশে মাতৃডাকে বাঙ্ময়,
গাছপালা, উদ্যান, পথরেখা, নদী-নালা, ব্রিজ দূরের
আকাশ
‘মা, মা’ বলে ডেকে ওঠে। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | একটি বনে সন্ধ্যেবেলা ঢুকে পড়েই মুষড়ে পড়ি,
হঠাৎ ভীষণ ক্লান্ত লাগে।
বন্য ঘ্রাণে ধরলো নেশা তড়িঘড়ি।
আগুন-রঙা স্বপ্ন জ্বলে তরুণ বাঘের পায়ের দাগে,
বনের মধ্যে মিশমিশে এক রাত্রি এল ক্রমান্বয়ে।
রাস্তাগুলি কোথায় এখন? চতুর্দিকে বনভূমি।
তোমার খোঁজে বনবাদাড়ে মত্ত হয়ে
ঘুরবো আমি চিরদিনই?
আমার দুঃখ-আলোয় ধৌত কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি?বনের মধ্যে হাঁটছি একা, বড় একা, নগ্ন পায়ে
ফুটছে কাঁটা বারে বারে।
হঠাৎ যেন শুঁড়ের মতো কিসের ঘায়ে
ধরলো জ্বালা সত্তা জুড়ে বেবুন, বেবুন অন্ধকারে।
দীর্ঘ ঘাসে জখমি মৃগের রোঁয়া কাঁপে,
দিক-ঠিকানা লুপ্ত সবই; চতুদিকে বনভূমি।
তোমার জন্যে কোন্ পুরনো অভিশাপে
কাঁদবো আমি চিরদিনই?
আমার থেকে সরে যাওয়া কৌমুদিনী
কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? কোথায় তুমি? (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আবীর-ছাড়ানো সকালে তুমি এলে আমার ঘরে। পড়ছিলাম
মিশেল ফুকোর
‘উন্মত্ততা এবং সভ্যত। উন্মত্ততা কি আমাকে
স্পর্শ করতে চাইছে? তোমাকে দেখেই
নড়ে-চড়ে বসি; তুমি জিগ্যেশ করলে
স্বতঃস্ফূর্ত হেসে, ‘কী করছো?’
‘এইতো এমন কিছু নয়’, বলে
মিশেল ফুকোর বই রেখে দিলাম টেবিলে।সারা ঘরে ছড়ানো তোমার ঘ্রাণ,
যেমন জীবনানন্দের কবিতায় রূপরসগন্ধ।
বেশিক্ষণ ছিলে না তুমি,
কয়েকটি কথা বললে, যেন সরোবরে বুদ্বুদ।
এমন কি চা খাওয়ার জন্যেও অপেক্ষা করলে না,
একটা লিটল ম্যাগাজিন উল্টে পাল্টে তুমি রাস্তায়।কেন এসেছিলো-এই প্রশ্ন আমার দিকে
ছুঁড়ে দেয় কবিতার খাতা, পেয়ারা গাছের পাতা।
উত্তরবিহীন আমার বসে-থাকা শূন্য ঘরে,
তোমার হাতের স্পর্শময় লিটল ম্যাগাজিন হতে চায় দোয়েল।আমার ঘর তোমার ঘ্রাণ সেই কখন থেকে
বুকে চেপে রেখেছে যক্ষের মতো,
এই আশ্চর্য ঘ্রাণ হারিয়ে যাওয়ার আগে
তুমি কি আসবে আবার? (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি
আমার জন্মশহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা শত শত গণ্ডারে
ভরে গেছে। কে জানে কোত্থেকে এসেছে এ পশুর দল।
হঠাৎ গণ্ডারের ভরাট মিছিল থেকে
উচ্চারিত হলো, “কে রে তুই বেল্লিক, বুরবক আমাদের
পশু বলে গাল দিচ্ছিস? বড় তো আস্পর্ধা তোর! এক্ষুণি
তোর টুঁটি ছিঁড়ে কাকপক্ষীকে খেতে দেবো আর উপড়ে নেবো
চোখ। সারা জীবন পথ হাতড়াতে হাতড়াতে কাটবে। বুঝলি বেয়াদব?”জানলা থেকে গণ্ডারের বিপুল মিছিল দেখে আর
ওদের ক্রুদ্ধ বক্তব্য শুনে পিলে চমকে তো গেলোই,
শিরার উষ্ণ রক্ত শীতল হয়ে গেলো এক লহমায়। আচমকা
কানে এলো এক ঘোষণা,-“হে নগরবাসী, যা বলছি মন দিয়ে
শোনো। তোমাদের শহর এখন
আমাদের দখলে। কেমন ক’রে গণ্ডার-প্রভুদের
দাসত্ব পালনের সুযোগ তোমরা পেলে তা জানার প্রয়োজন নেই।
তোমরা এমনই অথর্ব, এরকমই নিষ্কর্মা যে,
কারও না কারও প্রভুত্ব স্বীকার না করলে
তোমাদের উদরের অন্ন হজম হয় না। তাই এখন গণ্ডার-প্রভুদের
গোলাম তোমরা। হ্যাঁ, তোরা আমাদের
দাসত্ব করলেই থাকবি সুখে, মেদ জমবে তোদের শরীরে।জানলা দিয়ে ভোরবেলার রোদ আমার ঘুমন্ত
মুখের ওপর খেলা করতেই আমি
জেগে উঠলাম। জানলা রাস্তায় দৃষ্টি দিয়ে
গণ্ডারের মিছিল খুঁজি। না, তেমন কিছু নেই কোথাও।
সত্যি কি নেই? কেন যেন মাথায়, কপালে হাত
চলে গেলো নিজের অজ্ঞাতেই একটি কি দু’টি শিঙের উদ্দেশে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | নিজের বাড়িতে আমি ভয়ে ভয়ে হাঁটি, পাছে কারো
নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটে। যদি কারো তিরিক্ষি মেজাজ
জ্বলে ওঠে ফস্ করে যথাবিধি, সেই ভয়ে আরো
জড়োসড়ো হয়ে থাকি সারাক্ষণ। আমার যে-কাজ
নিঃশব্দে করাই ভালো। বাড়িতে বয়স্ক যারা, অতি
পুণ্যলোভী, রেডিয়োতে শোনে তার ধর্মের কাহিনী।
মক্ষিরাণী। সংসারে কেবলি বাড়ে শিশুর বাহিনী।
মেথর পাড়ায় বাজে ঢাক-ঢোল, লাউডস্পীকারে
কান ঝালাপালা আর আজকাল ঠোঙ্গায় সংস্কৃতি
ইতস্তত বিতরিত, কম্তি নেই কালের বিকারে।
বুকে শুধু অজস্র শব্দের ঝিলিমিলি। যে-সুকৃতি
জমেনি কিছুই তার কথা ভেবে মাথা করি হেঁট,
ঘুমায় পুরোনো বাড়ি, জ্বলে দূরে তারার সেনেট। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমার যুগল পা রক্তে ভাসে।যেখানে নিজস্ব পদচ্ছাপ
আঁকার সাধ ছিলো আশৈশব,
সেখানে পৌছুনো সহজ নয়।
ছিলো না সম্বল তেমন কিছু
খানিক ছিলো শুধু অহংকার।গড়তে চাইনি তো অকূল নদী,
দিগ্বলয় কিংবা পাহাড়ও নয়।
গড়ার সাধ ছিলো অন্তরালে
একটি চৌকাঠ স্বর্ণময়।তোমাকে প্রতিযোগী ভেবেই আমি
হয়েছি পথচারী অচিন পথে।
তাই কি তুমি সেই রুক্ষ পথে
রক্তপায়ী কাঁটা বিছিয়ে দিলে? (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | না, আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই, তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি ।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে-কোষে যারা পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা-
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে দশ হাত দূরে সর্বদাই।অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায়-কানায় রক্তে উঠবে ভরে,
যে রক্ত বাংলায় বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।অভিশাপ দিচ্ছি স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া-ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে দ্বারে-দ্বারে ঘুরবে ওরা।
প্রেতায়িত সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি...
অভিশাপ দিচ্ছি,....
অভিশাপ দিচ্ছি.... |
শামসুর রাহমান | রূপক | ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতেই চোখে পড়লো
একটি জবরদস্ত হাত এগিয়ে
আসছে আমার দিকে। বেজায়
ভড়কে গিয়ে অগ্রসরমান হাতের দিকে নিজের
হাত বাড়াবো কি না ভেবে ধন্দে পড়ে গেলাম,
অথচ তেমন ভয়ের কাঁটার খোঁচা পেলাম না।অচেনা লোকটার দিকে চেয়ার এগিয়ে দিকে
প্রাথমিক ভদ্র দৃষ্ট নিবেদন করার পর আলাপ
শুরু করলাম, আগন্তুক বেজায়
তুখোড় এবং অনেক কিছুই তিনি দিব্যি নিজের
এখতিয়ারে রেখেছেন এবং যখন যা খুশি
চটজলদি বলে যেতে পারেন
মন-জুড়ানো ভাষায়। তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিটি রূপবানও বটে।
হঠাৎ দেখি সেই ব্যক্তি মোমবাতির মতো দ্রুত
গলতে শুরু করেছেন। আমার দৃষ্টিকে বিশ্বাস
করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। একজন জলজ্যান্ত ব্যক্তির
এই রূপান্তরে হতবাক আমি দেখি তার চেয়ারে
এক হনুমান ব’সে আমার দিকে তাকাচ্ছে বেয়াড়া
তাচ্ছিল্যে, নিজেকে আমার লাগছিলো বড় বেখাপ্পা। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | তবে কি বৃথাই আমি তোমার ইঙ্গিতে দিগ্ধিদিক
ঘুরেছি ধারালো শীতে, দুঃসহ গরমে এতকাল?
হায় কী বিভ্রমে ম’জে দিনরাত্রি এক মজা খাল
সেচে সেচে দুহাতে তুলেছি কাদা নদী ভেবে ঠিক।
চতুর্দিকে কৌতূহলী লোকজন ‘ধিক, তোকে ধিক’
বলে উৎপীড়ক চোখ রাখে আমার ওপর, গাল
দিয়ে কেউ কেউ গদ্যে করে আমাকে নাকাল।
যত পারে ওরা গাত্র ঝাল তুমুল মিটিয়ে নিক।আমার বলার কিছু নেই, নিঃসঙ্গ থাকব বসে
অন্তরালে, ছায়ায় ভেতর থেকে যদি সুন্দরীর
আভাস চকিতে ফোটে, আলোড়নে কিছু পাতা খসে
পড়ে, তবে আমি তার উদ্দেশ্যে বলব সুনিবিড়
কণ্ঠস্বরে, তোমাকেই ঈশ্বরি মেনেছি আমি, তাই,
মনিরত্ন কিংবা ভস্ম যা-ই দাও, কোনো খেদ নাই। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কখনো কখনো ওরা আসে না, আবার কখনো বা
যুদ্ধ-ফেরতা সৈনিকের মতো এসে পড়ে, রচে শোভা
শূন্যতায়; মগজের পুকুরে সাঁতারপ্রিয় হৃদয়ের তন্ত্রী
কী রুদ্র ঝংকারে ছিঁড়ে সুবিস্তৃত রৌদ্রের ভেতরে যায়, যন্ত্রী
হ’য়ে ঘোরে, শাড়ির পাড়ের মতো রাঙা পথে, পতিত বাগানে।
বাউল বাউল ব’লে রসালো জ্যোৎস্নায় খুব মেতে ওঠে গানে।ওরা অলৌকিক ম্যানিফেস্টোর ডানায় ভর ক’রে
দ্রুত বিলি হ’য়ে যায় শহরের আনাচে কানাচে। গুঞ্জরিত ঘরে ঘরে
এবং স্থানীয় আঁদ্রে ব্রেতো করলে কৃপা বেহদ গাঁওয়ার সব
লজিকের বুকে-পিঠে রূপালি চাবুক হেনে আনকোরা রব
তুলে খিল ভরপুর জ্যোৎস্নায় বেবাক স্বপ্নাহত হয়।
দুস্থ চন্ডীমন্ডপের বুলির আড়ালে কতিপয়
শব্দ জাগে বলীয়ান নব্যতায়, কবিসংঘ পেয়ে যায় বিরল ভুবন,
স্বপ্নাদ্য বলাই যায়। রঙিন কুপনহাতে নিয়ে টপলেস পরীরা আঁধারে পরিচারিকার মতো
ব্যস্ততায় সঞ্চারিণী; মেঝে ফুঁড়ে ভৌতিক আলোয় উঠে আসে
অবিরত
অপরূপ শব আর শুয়োরের মুণ্ডু। পিরিচে যুল স্তন, যাত্রী
সবুজের দিকে ক্রমাগত। বইয়ের কবরে কে ঘুমায়? রাত্রি
চোলিতে নক্ষত্র গেঁথে চন্দ্রমাকে আনে বুদোয়ারে
নিরিবিলি প্লুত দৃষ্টি হেনে; অতিশয় মৌন হাড়ে
জ্যোৎস্না বোনে অন্তহীন কিংবদন্তী। এই তো প্রফুল্ল জোনাকিরা
গুল্মলতায় খেলে লুকোচুরি-বনময় কী আদিম ক্রীড়া।হে প্রিয় কল্পনালতা এসো তুমি উন্মাদিনী ওফেলিয়া সেজে
আমার এলসিমোরে, হে দয়িতা, পাখাবতী, শবাকীর্ণ ষ্টেজে। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | একন আমার মধ্যজীবন যীশুর মতন
ক্রুশকাঠে ক্রুর পেরেকময়;
তবুও হৃদয়ে প্রহরে প্রহরে মেঘবিস্তার,
এবং মোহন চন্দ্রোদয়।গ্রীষ্মে কি শীত দিন কাতরায় অফিস-গুহায়,
সন্ধ্যাবন্দি দাবার ছকে।
গেরস্থালির খোয়ারিতে মজে সোহাগ বিলোই
রাতে গৃহিণীর ঘুমেল ত্বকে।হঠাৎ কখন কৃপণ কলের পানি থেমে যায়,
কাকস্নান সারি নিত্য আমি।
ক্যালেণ্ডারের সুন্দরিগণ লিবিডো জাগান,
হযে যাই ক্রমে মর্ষকামী।রেশনের কৃশ লাইনে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল
ভাবি, আওড়াই লোর্কা, শেলি।
চকিতে চেতনা প্রবাহে ধরায় গনগনে জ্বালা
কবেকার নববধূর চেলী।কখনো ছুটির দুপুর কাটাই ভাতঘুমে আর
থ্রিলারে, সস্তা উপন্যাসে,
এবং বিকেলে চীনে বাদামের খোসা জমে ওঠে
খেলার মাঠের ধ্বস্ত ঘাসে।মোরগের মতো গলাটা ফাটিয়ে দিইনি শ্লোগান,
যাইনি যুদ্ধে একাত্তরে।
অবশ্য শত রাজা উজিরের শব উড়ে যায়
চায়ের কাপের তুমুল ঝড়ে।
মুখে বিপ্লবী বুলি লেগে থাকে আঠার মতন;
সমাজতন্ত্রে ঈমান আনি;
অথচ যখন জনকল্লোলে কাঁপে রাজপথ,
নিদ্রার মোহে চাদর টানি।নিউজপ্রিন্টে মারি ও মড়ক, গুপ্ত লড়াই,
কে কোথায় কবে চড়ছে শূলে—
রাখি না খবর; আপাতত আমি কাতরাই শুধু
পুরোনো আমার দন্তশূলে।ডাস ক্যাপিটাল জপি নিশিদিন, লেনিনের বাণী
করি মুখস্থ, তবুও হায়
আঁধি ও ব্যাধিতে দিশেহারা মনে ধর্মগ্রন্থ
কেমন অলীক ছায়া বিছায়।ভোরের আজান কি মায়া ছাড়ায় ফাঁকা রাস্তায়,
ঘুমন্ত ঘরে, বিবশ কানে।
আধখোলা চোখে দেখি বৃক্ষের আইবুড়ো ডাল
কাঁদে কোকিলের গায়েবি টানে।আমি বটে এক জাতস্বপ্নিক স্বপ্নের ঘোরে
মায়াজাল বুনি বন্ধ ঘরে।
আজো আরব্য রজনী আমার মগজের কোষে
রঙিন কুয়াশা সৃষ্টি করে।স্বদেশী মাটিতে ইদানীং আর টেকে না তো মন,
বাক্স প্যাঁটরা তৈরী থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য স্বর্গরাজ্য, তাই ভিটেমাটি
বেচে ছুটে যাই ভিসার ডাকে।মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি দেয়াল ঘড়িটা
পাখা নেড়ে যায় দূরের নীলে;
আমার ভেতর থেকে কার হাত বেরিয়ে চকিতে
ছিপ ফ্যালে ফিকে সবুজ ঝিলে।বাথরুমটার বালতির জলে, দেখি দৈবাৎ
ঝলমল করে কাস্পয়ান;
এবং চলেছে দূর শতকের ফিনিশীয় শাদা
পালতোলা এক সাগরযান।রঙ বেরঙের অজস্র পাখি ঠোঁটে নিয়ে ওড়ে
একটি কফিন পুষ্পঢাকা।
শূন্যতাময় দহলিজে নাচে রাজনর্তকী
দূর অতীতের ভস্মাখা।সন্ধ্যার মতো অন্ধ দুপুরে আমার উঠোনে
রোমক সেনারা খেলছে পাশা।
ওপরে পেরেকবিদ্ধ শরীর ক্রুশকাঠে গাঁথা,
শিয়রে আমার সাপের বাসা। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | অতীতের মায়াবী পাহাড় থেকে এ বর্তমানের
নিবিড় উপত্যকায় এসে দেখি জীবন ফিরিয়ে
আছে মুখ অন্ধকারে। একজন বৃদ্ধ গাঢ় স্বরে
বললেন হাত ছুঁড়েঃ “সৌন্দর্য, মহত্ত্ব সত্য আরসদ্গুণ ইত্যাদি রক্ষা করো, রক্ষা করো এ বাগান-
যেখানে পাখির গান শিল্পের প্রতীক খোঁজে প্রতি
লাল নীল ফুলে স্তব্ধ পাথরে মনের অস্তরাগে,
যেখানে হাতের মুঠো ভরে যায় সোনালি পালকে।“অন্ধকার জীবনের বাগানে নিগ্রোর মতো শুধু
আর্তনাদ করে ওঠে, মহত্ত্ব পিছল নর্দমায়
ভেসে যায়, সৌন্দর্য কবরে পচে, সত্য অবিরাম
উদ্ভ্রান্ত ভিখিরী হয়ে ঘোরে মনীষার মন্বন্তরে।আমার শয্যায় দেখি অজস্র মৃত্যুর ছায়া আর
হাজার হাজার ঘোড়া খুরের আঘাতে, কেশরের
আন্দোলনে আবার জাগাতে চায় মৃত শতাব্দীকে
আমার শরীরে, চোখে। আমি ছিন্নভিন্ন অন্ধকারে।একমুঠো তারা দিয়ে যদি কেউ আমার পকেট
ভরে দেয় কিংবা কতিপয় জনপ্রিয় খেলনা দেয়
হাতে তুলে-তবু আমি হাতের শিকড় দেব মেলে
জীবনের সমৃদ্ধ মাটিতে, স্বর হবো আশ্চর্যের।
ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাকে কাগজের মতো
যদি গুঁজে দেয় কেউ হাতে, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে
এক ফুঁয়ে পারবো না হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে সব।
কেননা শিখিনি ঘৃণা, বস্তুত ঘৃণায় নয় জানি,প্রেমেই মানুষ বাঁচে। চিরদিন বিমুগ্ধ নিষ্ঠায়
তাই শাদা চাঁদ কাফ্রি-রাত্রির প্রেমিকা পৃথিবীতে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | অত্যস্ত নিঃসঙ্গ, নগ্ন; কম্পমান, কবচকুণ্ডল
হারিয়ে ফেলবে নাকি, দেখছে সে দন্ত-নখরের
অব্যাহত আঘাতে নিজের শরীরের খন্ডগুলি
এখানে সেখানে, দরদর রক্তপাত। শক্ত হাতে
মাটি আঁকড়ে রোখে ক্রমাগত হিংস্রতার স্বেচ্ছাচার,
দাঁড়বার জায়গা খোঁজে, উদ্ভাসিত নতুন স্ট্বাটেজি
অকস্মাৎ; নেকড়ের পাল যত পারে লাফ ঝাঁপ
দিক, দাঁত ভেঙে যাবে, চুর্ণ হবে সকল নখর।নশ্বরতা চোখে নিয়ে বর্মহীন কোথায় সে যায়
ক্লান্ত নয়; যন্ত্রণা কর্পূর, একরত্তি ভয় নেই
বুকে, শুধু একটি চিবুক, ছলছলে দু’টি চোখ
ধ্যান ক’রে পথ চলে। দ্যাখে ধুলি ওড়ে, ইতস্তত
ছাগ-খুরে নাচে কত প্রতিভাবানের খুলি আর
সে প্রত্যহ বৈঠা বায় খরশান গহন নদীতে। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | সর্বাঙ্গে আঁধার মেখে কো করছো এখানে খোকন?
চিবুক ঠেকিয়ে হাতে, দৃষ্টি মেলে দূরে প্রতিক্ষণ
কী ভাবছো বসে?
হিজিবিজ়ি কী আঁকছো? মানসাঙ্ক কষে
হিসেব নিচ্ছো? দেখছো কি কতটুকু খাদ
কতটুকু খাঁটি এই প্রাত্যহিকে, ভাবছো নিছাদ
ঘরে থাকা দায়, নাকি বইপত্রে ক্লান্ত মুখ ঢেকে
জীবনের পাঠশালা থেকে
পালানোর চিন্তাগুলো ভ্রমরের মতো
মনের অলিন্দে শুধু ঘোরে অবিরত?থাক, থাক-
মিথ্যে আর বাজিও না দুশ্চিন্তার ঢাক।
নীলের ফরাশে দ্যাখো বসেছে তারার মাইফেল আজো, শোনো
কী একটি পাখি ডেকে ওঠে না-না হয়নি এখনো
অত বস্তাপচা এই সব। লজ্জার কিছুই নেই,
দ্যাখো না খুঁটিয়ে সব আর দ্যাখো এই
লণ্ঠনের আলো, সম্মোহনে যার কল্পনার ওড়াতে ফানুস,
পোড়াতে আতশবাজি আনন্দের খুব,
আশ্চর্যের হ্রদে দিতে ডুব!
করেছো কামনা যাকে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা, আমি সেই আজব মানুষতোমার পাড়ায় আজ বড়ো অন্ধকার। সম্ভবত
বাতিটা জ্বালাতে ভুলে গেছ, আমি অভ্যাসবশত
কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি। মস্ত উজবুক
এ লোকটা-বলে দাও দ্বিধাহীন। ভয় নেই, দেখাবো না মুখ
ভুলেও কস্মিকালে। তোমরা কি অন্ধকার-প্রিয়?
চলি আমি, এই লণ্ঠনের আলো যে, চায় তাকেই পৌছে দিও। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | স্মৃতির ভেতরে ঘুরে ঘুরে একটি মরাল কাঁদে,
পায়ে তার নুড়িগুলি অথবা কাঁকর চুমো খায়
অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। রক্ত ঝরে আর কৃশকায়
অলবডো লোক কতিপয়, খুনখুনে বুড়ো, কাঁধে
ঢাক নিয়ে খুব ঢক্কা নিনাদে চাদ্দিক অবসাদে
ভরে তোলে ক্রমান্বয়ে। স্মৃতির ভেতরে গান গায়
শহুরে কোকিল, যার চক্ষুদ্বয় অন্ধ; অসহায়
আমি ভাবি-তার সঙ্গে দেখা হবে কতদিন বাদে?ফের যদি তার সঙ্গে দেখা হয় দীর্ঘ দীর্ঘকাল
পরে বিরানায় কিংবা কোনো নৈশ তুখোড় পার্টিতে,
যদি সে আমার চোখে দুটি গাঢ় চোখ রাখে ভুলে
তবে কি সহসা যাবে কেটে তার সামাজিক তাল?
সে কি বন্দী শিবিরের কথা ভুলে প্রাক্তন নিশীথে
ফিরে যাবে নিমেষেই? উঠবে কি তার বুক দুলে? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | পরিণামদর্শী ছিলাম না কোনোকালে,
তা বলে এমন সাজা পেতে হবে, ভাবি নি কখনো।
নিজকে তখনো এরকম অনাশ্রিত, অসহায়
আমার হয় নি মনে। অপরাধ করি নি, তবুও
অপরাধী বলে শক্রদল তর্জনী উঁচিয়ে খোলা
রাস্তায় আমাকে নিয়ে সার্কাস বানাবে।শেষ অব্দি আমাকে নিয়েই যাবে, জানি।
তার আগে আত্মজের শিশু কন্যাটিকে
আরো কিছু কাল আদর করতে দাও; মায়ের মমতা,
আরো যারা হৃদয়ের খুব কাছে আছে
তাদের প্রীতির স্পর্শ পেতে দাও। প্রিয় স্মৃতিগুলিকে আবার
ডেকে আনতে চাই, আর না-লেখা কবিতাগুলি যেন
অভিমানে আমার মানস থেকে মুখ ঢেকে ফিরে
না যায় নিশ্চুপ, দাও, নির্বিঘ্ন, প্রস্তৃতি।আমার ঘরের বই, চায়ের পেয়ালা, আসবাব
কী স্বপ্ন দেখছে আমি এখনো পারি নি জানতে, জেনে
নিতে চাই; সুন্দর আমাকে
করুক নিভৃতে স্পর্শ বার বার, তাহ’লে সহজে
দুর্লঙ্ঘ দেয়াল পার হ’য়ে যেতে পারি। করজোড়ে বলে যাই-
আমার সময় চাই, সৃজনের আরো কিছু স্পন্দিত সময়। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | বিকেল বেলা এখানে এসেই লোকটা কেমন
ভ্যাবাচ্যাকা। এত হৈ চৈ, অথচ কেউ কারও কথা
শুনছে ব’লে মনে হচ্ছে না। শব্দগুলো
ইট পাটকেলেত মতো ঠোকাঠুকি করছে অবিরত।লোকটা শত চেষ্টা ক’রেও কারও দৃষ্টি
ওর দিকে ফেরাতে না পেরে
মুখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। সারা মুখে ভর
সন্ধেবেলার
অন্ধকার, মাথার ভেতর অন্ধ পাখির ঠোকর।এখনই অন্ধ বন্ধ কোনো না পাখা,
লোকটা নিজেকে প্রবোধ দেয় চারপাশে
স্তব্ধতার মনোজ জাল ছড়িয়ে। লোকটার মাথা
ক্রমাগত মেঘ স্পর্শ করার বাসনায় স্পর্ধিত হয়।ওদের কিছু কথা শোনাবার ছিল লোকটার,
কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনার
ব্যগ্রতাকে নাচায়নি চোখের তারায়
পরিণামহীন হৈ-হল্লাই ওদের অধিপতি।লোকটা আখেরে বলতে-চাওয়া কথাগুলো
বুকের ভেতর গুছিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়াল এক
ভিড়
গাছপালার মধ্যে। ওর মুখে মুক্ত উচ্চারণ; গাছ, পাখি,
নির্জনতা আর বাংলা লিরিকের মতো চাঁদ তার শ্রোতা। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | বহুদিন পর একটি কবিতা লেখার জন্যে কদম ফুলের মতো
শিহরিত আমার স্নায়ুপুঞ্জ অর্থাৎ আমি ফের সুর দড়ির পথিক,
আমার দিকে নিবদ্ধ হাজার হাজার উৎসুক চোখ।
যতক্ষণ দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছি চমৎকার,
খেলা দেখাতে পারছি হরেক রকম,ততক্ষণ দশদিক-কাঁপানো করতালি
আর পা হড়কে পড়লেই থমথমে নিস্তব্ধতা, রি রি ধিক্কার।কিছুকাল হাঁটেনি যে মানুষ, সে যেমন একটু পা চালিয়ে
পরখ করে নেয় নিজের চলৎশক্তি,
তেমনি হড়বড়িয়ে এই লিখে ফেলছি পংক্তিমালা; অথচ
এতদিন পর বাস্তবিকই বাক্যগুলি সযত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়া দরকার।কে না জানে কবিতার একটি প্রকৃত পংক্তি রচিত হবার আগে
বহু বাক্য অস্ত যায়, ঝ’রে যায় অনেকানেক
উপমার কুঁড়ি আর দু’টি বাক্যের ব্যবধানে
দীর্ঘস্থায়ী হয় ঈগল আর পাহাড়ি গিরগিটর বিবাদ,
ঝিলের ধারে পড়ে থাকে
বাঘ-তাড়িত ত্রস্ত হরিণের খাবলা খাবলা মাংস,
থাকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে কম্পমান খরগোশ; কখনো সখনো
কবরের স্তব্ধতাও, কখনো বা নবজাতকের জন্মধ্বনি।এখন আমি হাতে কলম তুলে নিয়েছি
এমন একটি কবিতা লেখার জন্যে, যার ডান গালে টোল পড়ে সুন্দর,
যার চোখ দূর নীলিমায় সন্তরণশীল,
যার পরনে নীল শাড়ি, মেঘলা খোঁপায় রক্তজবা,
যার নখ সূর্যোদয়ের রঙে সজীব,
যার কণ্ঠস্বরে রাত্রির মমতা, যুগল পাখির
শব্দহীন ভালোবাসা আর গহীন অরণ্যের বুকচেরা জ্যোৎস্না।
সত্যের মতো সে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার ধারে বৃষ্টির দুপুরে,
ফুল ছাড়া কোন অলঙ্কার তার নেই, সত্যের কোনো অলঙ্কারের দরকার হয় না।
এই মধ্যরাতে একটি কবিতা হৃৎপিন্ডের মতো স্পন্দিত
হচ্ছে, বেড়ে উঠছে, যেন নানা অলিগলি,
লতাগুল্মময় পথ আর কোন একটি বাড়ির
নিদ্রাতুর ঘরের জানালা-ছুঁয়ে-আসা স্মৃতি।আমার ভেতরে যখন কবিতা বেড়ে ওঠে মুহূর্তে মুহূর্তে,
দেখি বরহীন বরযাত্রীগণ আর্তনাদ করতে করতে গড়িয়ে পড়ে যান খাদে,-
সে আর্তনাদে গুলিবিদ্ধ রাজহাঁসের ক্রন্দন,
সতীদাহের চোখে-জ্বালা-ধরানো ধোঁয়ার ভয়ৎকর উদ্গীরণ-
দেখি একজন ক্ষ্যাপাটে বাঁশি-অলা ফুটপাথে গেরস্থালি
করতে এসে পরিবারসহ ফৌত হয়ে যায় ব্যাপক মড়কে;
নরকের গনগনে ধুম্রজাল ছিঁড়ে
বাতিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আসে
এক অচিন বালক, তার কাঁধে ত্রিকালজ্ঞ পাখি,
মাথায় বর্ণিল পালকের মুকুট।
এখনো মানুষ বালিশে মুখ চেপে ডুকরে ওঠে ব’লেই,
এখনো মানুষ বড়ো একা একা থাকে ব’লেই,
রাতের তৃতীয় প্রহরে কারো আঙুলের ফাঁকে
সিগারেট পুড়ে যায় ব’লেই,
দিনান্তে কিংবা মধ্যরাতে অন্ধকার ঘরে ফিরে কেউ বাতি জ্বালে ব’লেই,
ক্লান্ত পথিক বনবাদাড়ে দিক ভুল করে ব’লেই
মাঝে-মধ্যে টেলিফোন সবচেয়ে সুকন্ঠ পাখির মতে।
গান গেয়ে ওঠে ব’লেই,
গেরস্তের সংসার থেকে কখনো কখনো নিরুদ্দেশযাত্রা আছে ব’লেই,
প্রতিশ্রুতিময় হাতের কাছে আজো হাত এসে যায় ব’লেই,
ম্লান জ্যোৎস্নায় শেষরাতে নৌকো ঘাট ছেড়ে যাত্রা করে ব’লেই,
মনে পর্দায় পলনেস্কির ছবির মতো ভয়াবহতা কম্পমান ব’লেই,
অসুখী বিবাহের মতো নক্ষত্র, ভিখিরীর ন্যাকড়া, ঈগল
আর গুবরে পোকার সম্মিলন আছে ব’লেই,
প্রাচীন মিশরীয় সমাধির চিত্ররাজির মতো স্মৃতি খেলা করে ব’লেই,
এক-গা ভস্ম ঝেড়েঝুড়ে কবিতা জেগে উঠে
মাটির ঠোঁটে চুমো খায় আর বিখ্যাত উড়াল দ্যায় মেঘের মহালে।
আমার অন্তর্গত সরোবরে চুঞ্চ ডুবিয়ে ডুবিয়ে প্রাণ সঞ্চয় করছে যে-কবিতা
তা’ অপলক তাকিয়ে থাকে আরেক কবিতার দিকে
এবং সেতুবন্ধের গান গাইতে গাইতে চুম্বন হয়ে চলে যায়
তার দিকে, যার পায়ের কাছে শায়িত শীয়ামিজ বেড়াল,
যার দোরগোড়ায় এক তরুণ তেজী ঘোড়া
রহস্যের ছন্দে গ্রীবা দুলিয়ে দুলিয়ে
কেবলি স্বপ্ন ছড়াচ্ছে সেই কবে থেকে, প্রহরে প্রহরে। (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হায়রে মন, না জেনে আমি, আপন খবর
তালাশ করি চেতন গুরু; আন্ধারে হোঁচট খেতে-খেতে
জনমভর দেখলাম না লালনেরে। হঠাৎ
কীসের ঝলক দিলো দিলে, শুনি গাঢ় মেঘের
আড়াল থেকে লালন কয়, ‘পাঠাস নাই তুই আমার
নামে পত্র কোনো; অনেককাল হেলার কাদায়
রেখেছিস ফেলে। কোতায় পাবো অচিন ডাকটিকিট?
কোথায় তেমন নীল ডাকরাক্স? কোথায় আপনি সাঁই?দোতারায় আলো-কুসুম ফুটিয়ে লালন
বলেন উদাস কণ্ঠস্বরে, ‘ফোটাতে চাস আনন্দকুসুম
শূন্য ডালে? তবে কেন একলা এলি আমার সন্ধানে জেল্লা-অলা
পোশাক পরে? হৃদয়রতন কোথায় রেখে এসেছিস কোন্
ঝরা পাতাদের কবরে? গৌরীকে ফেলে এসে সামান্যে
তারার হাটে, ওরে ক্ষ্যাপা, তুই অসামান্যের সুর বাজাবি?’ |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | মেঘম্লান চন্দ্রালোকে ক’জন বামন শুদ্ধাচারী
যাজকের জোব্বা গায়ে মহত্তম যুগের স্মরণে
জুটেছে রাস্তার মোড়ে। “দ্যাখো এই পৃথিবীকে দ্যাখো,
আমাদের কীর্তিমান অগ্রজেরা জোগালেন যাকে
স্মরণীয় দিনের মহিমা, যাকে নাটকের শেষ
দৃশ্যের বিক্ষুব্ধ নায়কের মতো শোকে ত্যাগ করে
কালান্তরে করলেন নিঃশব্দে প্রস্থান, তাকে নোঃরা
করেছে অজস্র জন্তু, পবিত্রতা বিগত সুদূর
শতাব্দীর মতো অনাত্মীয়। মোট কথা, ইতিমধ্যে
সযত্নে লালিত সেই পৃথিবীর কতটুকু আর
অবশিষ্ট ধ্যাননেত্রে? হাসি পায়, যখন সম্প্রতি
দেখি কনিষ্ঠেরা শুধু অবিশ্বাস্য ছলে সরাসরি
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে জীবনকে পরায় মুকুট।
অথচ জানে না তারা তাদেরও নিস্তার নেই সেই
ধ্বংসের প্রহার থেকে, হবে শবাগার জীবনের
সমস্ত বৈভব। সে বিপুল অর্থহীন অপচয়ে
তারাও নিশ্চিত লিপ্ত আজীবন। তারাই ইন্ধন”বলে সেই বামনেরা বাজালো ভ্রান্তির ডুগডুগি।
দূর হ হতাশা,
যা তুই নচ্ছার! জীবনের ত্রিসীমায়
দেখাবিনে মুখ আর, যা তুই ফিরে যা!
মৃত্যুর গোলামি করগে যা, আমরাতো সর্বক্ষণ
জীবনের স্তবে আন্দোলিত,
মজ্জাগত উৎসবের উজ্জ্বল চিৎকার।
সময়ের স্বগতকথনে বার বার
কান পাতি, প্রাজ্ঞ পদাবলী, প্রতীকের উচ্চারণ, রূপাভাস,
গাঁথি মগজের কতো শাণিত ফলকে!সাধারণ হলেও অন্তত
অতিশয় লঘুমতি যুবা নই, অলৌকিক মন্ত্রের মায়ায়
কবরের ধুলিকে বানাই
নক্ষত্রের ফেনা, যত পারি দূরে রাখি
অনুশোচনার মলময়
কীটের স্বৈরিতা! অমরত্ব কাকে বলে জানি না তা,
সে-জ্ঞানে উৎসাহ কম, বাছা-বাছা ভাষ্যকার তার
দিয়েছেন যে-ব্যাখ্যা তাতেও
কখনো ওঠেনি মন। পিতৃপুরুষেরা
ধারণার যে ক’বিঘে জমিতে লাঙল চষে কিছু
শাক-সবজি, সাধের আনাজ
তুলেছেন ঘরে, সেগুলো রোচেনি মুখে।আমরা নতুন শব্দ ছুঁড়ে দিই সময়ের মুখে,
সেই শব্দে মুগ্ধ হয়ে কোনো স্থির সহজ সিদ্ধান্তে
না-এসেই আমরা অনেকবার সাগ্রহে হয়েছি পার কতো
স্বল্পজীবী নালিমার সাঁকো!বলা যায় না করে অধিক বাক্যব্যয়
বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে ক্রমাগত
বিখ্যাত বসন্ত শুধু করছে বিশ্বাসঘাতকতা।
ভুলেছে স্বধর্ম তার, আমাদের আকাঙ্ক্ষার ডালে
দেয় না ফুলের গুচ্ছ, পক্ষান্তরে চৈতন্যের আনাচে কানাচে
সর্বদা দিতেছে ছুঁড়ে তিরস্কার। নষ্ট বাগানের
ভ্রষ্ট কিছু পাখি।
কবরখানার গান গেয়ে-গেয়ে নিজেরাই ছায়া হয়ে যায়।
এ শহরে চতুর্দিকে ভিড়, চতুর্দিকে
বামনেরা জটলা পাকায়
এবং চাঁদের নখ উপড়ে আনবে ভেবে তারা
গুটিয়ে জোব্বার হাতা এলাহী রগড় করে শেষে
থুতু ছুঁড়ে দেয়
আকাশের মুখে।মহামান্য বামনেরা সময়ের বিবাহ-বাসরে
অতিথির ভূমিকায় ক্লান্ত হয়ে কন্যাপক্ষ সাজেঃ
অনেক মোড়লি করে-গাঁয়ে না মানুক
তাতে কী বা এসে যায়
সভায় আনতে গিয়ে কনে
আলমারি থেকে টেনে আনে সম্পন্ন ফরাসে এক
প্রাচীন কংকাল!
তারপর বনেদি কেতায় হেসে ওঠে,
যেন তীব্র ফুর্তির প্রগল্ভ পিচকারি
ছুঁড়ে দিলো দুঃস্বপ্নের সংখ্যাহীন বিন্দু,
অন্দরে-বাহিরে
লণ্ডভণ্ড সব,
পণ্ড হলো বিবাহ-বাসর।বাদ দাও শৃগালের বিখ্যাত ধূর্তামি,
মুখোশের বিচিত্র কল্পনা বাদ দাও।
তুমি কি মিথ্যার জালে পারবে ধরতে
অতর্কিতে উল্লিখিত সত্যের ঈগল
কোনোদিন? পারবে কি সময়ের ত্বক
ছিঁড়ে ফুঁড়ে জন্ম দিতে সোনালি আপেল-
মাংস যার জানবে না অবক্ষয়, শুধু
চৈতন্যের নিঃসংশয় প্রভাবে সে-ফল
চেনা পরিবেশে পাবে শিল্পের মহিমা!পথে ছুটি দিশাহারা, ফতোবাবুদের
ভিড় দেখি ছত্রভঙ্গ। বিভ্রান্তি চৌদিকে
প্রত্যহ ছড়িয়ে পড়ে প্রবাদের মতো।
পিকাসের গার্নিকা ম্যূরাল মনে পড়ে-
ক্রুদ্ধ সেই ঘোড়াটার আর্তনাদ যেন
আমাদের কাল। আমরা ভয়ার্ত চোখে
ধূর্ত মর্ত্যজীবীদের করুণা কুড়াই
অহর্নিশ। অগোচরে স্বপ্নের ঘোড়াকে
ঝোঁটিয়ে বেড়াই, ভাবি তাকে তাড়ালেই
থাকা যাবে নিশ্চিন্তির সম্পন্ন কোটরে।অথচ অবাক লাগে যখন স্বপ্নের গলিঘুঁজি
পেরিয়ে ব্রোজ্ঞের তপ্ত চত্বরে দাঁড়াই,
বাঁচবার চেষ্টা করি তীব্র বক্তব্যের
অন্তরঙ্গতায়,
সামনে তাকিয়ে দেখি পরিবর্তনের
টগবগ ঘোড়া
থমকে দাঁড়ায় নৈঃশব্দ্যের ক্ষণস্থায়ী প্রাঙ্গণের
এক কোণে, এবং মাথায় তার স্বপ্নের কিরীট
সম্মোহনে একান্ত নির্ভর।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে সুতীক্ষ্ণ বাতাসে
এবং তখন
ক্ষুধার্ত চোয়ালে তার বাস্তবের খড়কুটো নড়ে!যেদিকে তাকাই
নিশ্চয়তা কিছু নেই। দুর্যোগের দিনে
মাদুলি তাবিজ তুকতাক নিয়ে মেতে আছে যারা,
সর্বক্ষণ যারা
পশুদের দাসত্বে বিলীন,
যাদের আত্মায় শুধু পশুদের বিষ্ঠা স্তূপীকৃত-
ভদ্রমহোদয়গণ, তাদের নিষ্ঠায়
তিলমাত্র করি না সন্দেহ,
অথচ নিশ্চিত তারা লোকালয় ছেড়ে
কবরখানায় খোঁজে স্বেচ্ছা নির্বাসন
বস্তুত নিজেরই অগোচরে।চতুর্দিকে যে বিচিত্র চিত্রশালা দেখি রাত্রিদিন
তাতে সবি ব্যঙ্গচিত্র। চোখ জুড়ে আছে কিমাকার
জীবনমথিত দৃশ্যঃ বিশিষ্ট প্রতিভাবানদের
আত্মার সদগতি করে সম্মিলিত শৃগাল ভালুক
ফিরে আসে ময়লা গুহায়। নির্বোধেরা সারাক্ষণ
গড়ছে এমন সিঁড়ি যা-দেখে শিউরে ওঠে দূরে
ভূশণ্ডীর কাক। দুঃস্বপ্নের জোড়াতালি দিয়ে-দিয়ে
লিখেছে প্রাচীরপত্র সর্বনাশ বড় জাঁক করে।
পৃথিবীর সব কিছু ধোপানীর গালগল্প ভেবে
পথে বসে হতবুদ্ধি হয়ে যাই বামনের দেশে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রকৃতিমূলক | এ পথে আমার পর্যটন তেমন নতুন নয়,
তবু কেন হঠাৎ একটি মোড়ে এসে
দাঁড়ালে কেমন যেন অচেনা, অদেখা
মনে হয়; আনন্দে ময়ূর হয় চেতনা আমার।এই গাছ ছিল না কোথাও, এই ঝিল কোনোদিন
পড়েনি সতৃষ্ণ চোখে, এর জলে ডুবাই নি হাত
আগে কিংবা তীরবর্তী ঘাসে
শুয়ে কায়ক্লেশে ধীরে মুছে নিতে করিনি প্রয়াস।এ পথে বিশ্রাম নিলে বেশিক্ষণ, কখন যে চোখ
নিভাঁজ, প্রগাঢ় ঘুমে বুজে আসে, ঝরে
শুক্নো পাতা সমস্ত শরীরে, আহরিত জ্বলজ্বল
আশরফি মাটির ঢেলা হয়ে যায় অবলীলাক্রমে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ,
মনে চিন্তার নেইকো লেশ।ডানে বললে ঘুরিস ডানে,
বামে বললে বামে।
হাবে ভাবে পৌঁছে যাবি
সোজা মোক্ষধামে।
চলায় ঢিমে তালের রেশ,
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ।যাদের কথায় জগৎ আলো
বোবা আজকে তারা,
মুখে তুবড়ি ছোটে যাদের
আকাট মূর্খ যারা।দিনদুপুরে ডাকাত পড়ে
পাড়ায় রাহাজানি,
দশের দশায় ধেড়ে কুমির
ফেলছে চোখের পানি।
পৃথিবীটা ঘুরছে ঘুরুক
মানুষ উড়ুক চাঁদে,
ফাটায় বোমা সাগর তলায়
পড়ছে পড়ুক ফাঁদে।
তোর তাতে কি? খড়বিচুলি
পেলেই পোয়াবারো।
জাবর কেটে দিন চলে যায়,
পশম বাড়ুক আরও।জগৎ জোড়া দেখিস ঐ
সবুজ চিকন ঘাসের দেশ।
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ! (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমাকে টপ্কে তুমি যাও হে কোথায়? খাও টক
কুল ভর সন্ধ্যেবেলা। বই মেলায় যাবে বুঝি আজ
বাসন্তী রঙের শাড়ি প’রে? চায়ের দোকানে ব’সে
গল্মগুজবের স্রোতে ভেসে-যাওয়া, ফুচ্কা খাওয়া,
কখনও একটি দু’টি বই কেনা ফিরতি পথে, তুমি
জানবে না একজন কবি তোমাকে না দেখে দুঃখে
একা ঘরে কাটায় সময় বোদলেয়ারের সঙ্গে,
কখনও বা উদাস তাকিয়ে থাকে নক্ষত্রের দিকে,বুকে তার এক রাশ অন্ধকার, সেখানে ফোটে না
এমুহূর্তে কিছুতেই ফুল কিংবা তারা। দাঁড়াশের
ছোবলে কাতর তার বিবাগী অন্তর; ঘরে ফিরে
জামা টামা খুলবে যখন পড়বে কি মনে তাকে,
যে তোমাকে হৃদয়ে রেখেছে ভ’রে অত্যন্ত গোপনে,
প্রতিটি নিঃশ্বাসে যার তুমি নিয়ত স্পন্দিত, মেয়ে। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কী-যে হলো, কিছুদিন থেকে
আমার পড়ার ঘরে আজগুবি সব দৃশ্য জন্ম
নেয় চারদেয়ালে এবং
বইয়ের শেল্ফে, এলোমেলো, প্রিয় লেখার টেবিলে।কতবার গোছাই টেবিল
সযত্নে, অথচ ফের কেন যেন হিজিবিজি অক্ষরের মতো
কেমন বেঢপ রূপ হয়ে
আমাকে সোৎসাহে ভ্যাঙচায় লেখার সময়।ওরা কি আমার রচনার
পরিণাম বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কলম থামাতে চায় এই
অধমের? লুকাবো না, আমি
ভীত চিত্তে কলম থামিয়ে দূরে দৃষ্টি মেলে দিই।আচমকা কতিপয় দীর্ঘদেহী প্রেত
লেখার টেবিল ঘিরে ধেই ধেই নেচে আমাকেই
বিদ্রূপের কাদায় সজোরে ঠেলে দিয়ে
দন্তহীন ভয়ঙ্কর মুখে ক্রূর হাসি হাসে!২
কোত্থেকে ঘরে ভুতুড়ে আঁধার ঢুকেছে হঠাৎ,
ভেবেই পাই না। আঁধার এমন দংশনপ্রিয়
হতে পারে, আগে জানতে পারিনি। নিজ হাতকেই
কেমন অচেনা বলে মনে হয়। ভয়ে কেঁপে উঠি।ভয় তাড়ানোর চেষ্টায় দ্রুত চড়িয়ে গলার
ধ্বনি এলোমেলো কীসব আউড়ে গেলাম কেবল।
আকাশে এখন চাঁদ আর তারা দেবে না কি উঁকি?
কেউ কি আমার গলা চেপে ধ’রে করবে হনন?কারা যেন ছুটে আসছে এদিকে। ওরা কি দস্যু?
নাকি আগামীর ঘটনাবলির বেঢপ আভাস?
হঠাৎ আমাকে ভগ্ন বাড়ির স্তূপের ভেতর
কাতরাতে দেখি। কিছু ধেড়ে পোকা চাটছে জখম।আমার দেশের চারদিক জুড়ে ক্রূদ্ধ পানির
দংশনে আজ পাড়া গাঁ এবং শহর কাতর।
ভয় হয় যদি হঠাৎ প্লাবন বাড়িঘর সব
মানুষ সমেত ঘোর বিরানায় মুছে ফেলে দেয়।৩
এখন কোথায় আমি? কে আমাকে এই
নিঝুম বেলায় বলে দেবে? এখানে তো ডানে-বামে
জনমানুষের চিহ্ন নেই। বড় বেশি শূন্যতার
হাহাকার অস্তিত্বকে নেউলের মতো
কামড়াচ্ছে সারাক্ষণ। ভাবছি, এখন যদি কোনও
কুশ্রী মানবেরও পদধ্বনি শুনি বড় ভালো হয়।কখনও হতাশা যেন সমাজকে, দেশকে বিপথে
টেনে নিয়ে অন্ধের আসরে
আরও বেশি অন্ধ, বোবা জমা ক’রে ঘন ঘন জোরে
করতালি দিয়ে আরও বেশি জম্পেশ আসর না বসায়।আজকের এই বোবা অন্ধকার লুটপাট আর
অস্ত্রবাজি, আমার বিশ্বাস, আগামীর
সকালে, দুপুরে, রাতে পারবে না মাথা তুলে দাঁড়াতে নিশ্চিত,
যখন স্বদেশ রক্তগোলাপের মতো প্রস্ফুটিত। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | সারা পথে ধুলো ছিল, কাঁটার
শাসন ছিল, কাঁকরের বিরূপতা সইতে
হয়েছে ঢের। জানতাম না পা দুটোকে রক্তাক্ত করে
কায়ক্লেশে এখানে পৌঁছে
দেখতে পাব সরোবরের উদ্ভাসন। এখানে আসার
কথা ছিল না, তবুও এলাম।সরোবরের টলটলে জলে মুখ রেখে
তৃষ্ণা মেটাই ব্যাধের বিপদে থেকে ছুটে-আসা
বনের প্রাণীর মতো। দূরে তাকিয়ে দেখি,
তুমি দিগন্তের মহিমা থেকে বেরিয়ে আসছো;
তোমার শাড়ির রঙের বিচ্ছুরণ কলাপ মেলে আকাশে,
আমার আকাঙ্ক্ষা সুদূরপ্রসারী।যখন নত আমি তোমার মুখের উপর,
তুমি রহস্যের ভাস্কর্য।
তোমার স্তনের নগ্নতাকে চুমো খাই যখন, তখন ধানের শীষ
ফোটে গানের গানে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখি
শিঁস দেয়, কৃষকের কুটির দুলে ওঠে বসন্ত বাহারের সুরে
এবং ছিপছিপে নৌকো তীর ছেড়ে এগোতে তাকে জল চিরে।তোমার নাকে ক’ ফোঁটা ঘাম, যেন ভোরের
পাতায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু। তোমার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ
আমাকে বানায় মাতাল তরণী, অপ্রতিরোধ্য
কামনার হাত চেপে ধরি। কী কথা বলতে গিয়ে বোবার
অস্বস্তি রাখি ঢেকে; বিষণ্ন, রক্তচক্ষু কোকিল
নীরবতা পোহায় নগ্ন পাতার আড়ালে।আমার হৃদয়ে প্রেম মজুরের কর্মচঞ্চল
রগের মতো দপদপ করে। জীবনের
সঙ্গে আমার গভীর দৃষ্টি বিনিময় হলো,
যখন তোমার মধ্যে দেখলাম পবিত্র অগ্নিশিখা আর
সেই মুহূর্তে তুমি আমাকে এনে দিলে একরাশ পতঙ্গের
ভস্মরাশি, যাতে ভালোবাসার অর্থ বুঝতে ভুল না হয় আমার। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | প্রস্থানের কালে তুমি বলেছিলে, ‘প্রিয়তম কবি,
খারাপ করো না মন, ক’টা দিন হাসিখুশি থেকো।
কী করে ফুটবে হাসি মনে, যখন তোমাকে আমি
দেখতে পাবো না আর শুনতে পাবো না কণ্ঠস্বর
তোমার? তা ছাড়া দেশ রাহুগ্রস্ত, মৃত্যুর খবর
পাই প্রতিদিন, নরহত্যা নেহাত মামুলি, দেখি
পুলিশের লাঠির আঘাতে মিছিলের ক্ষুব্ধ ছাত্রী
রাস্তায় রক্তাক্ত পড়ে থাকে হায়, যেন বাংলাদেশ।প্রিয়তমা আমার, তোমার কথা, প্রেমময়ী দৃষ্টি
মনে পড়ে প্রতিক্ষণ মনে হয়, রেখেছো আমার
হাতে এসে তোমার উৎসুক হাত পল, অনুপল
শতাব্দীর রূপ নেয় স্বপ্নঘোরে। সমূহ সঙ্কট,
স্বৈরাচারী দুঃশাসন এবং তোমার বিচ্ছেদের
ধারালো দাঁতের হিংস্রতায় জিন্দা লাশ হয়ে হাঁটি। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | একটি পাখিকে খুঁজছি সেই কবে খেকে
শহরের গালিঘুঁজিতে আনাচে কানাচে সবখানে
তন্ন তন্ন করে খুঁজছি
কী সুন্দর দেখতে সেই পাখি আর গলায় স্বর্গীয় গানপাখিটাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার মাথায়
আলাস্কার এক স্তূপ বরফ
একটা নেকড়ে বরফ চিবিয়ে চিবিয়ে
খাওয়ার জন্য খাটিয়ে দেয় হিংস্রতার পালশহুরে গাছের পাতায় পাতায় রাখি কড়া নজর
প্রতিটি জানলায় বুলাই চোখ
দীর্ঘ ঘাস সরিয়ে দেখতে চাই সেই পাখির নাচানাচি
হায় আমার মনেই পড়েনি সে মৃত অনেক আগেই (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | ঝেড়ে ফেলে দিতে দেশজোড়া
অনড় পাথর
শুধু রাজধানী নয়, আমাদের প্রতিটি শহর
এবং শহরতলী গ্রাম
ক্রুদ্ধ মানুষের কপালের
শিরার ধরনে করে দপ দপ। কখনো দেখিনি,
তবু তোমাদের কথা ভেবে
আমাদের হৃদয়ের চোখে অশ্রধারা বয়,
স্ফীত হয় বুক। তোমাদের বুক থেকে
রক্তের ঝলক এই মানচিত্রটিকে
আরো বেশি রক্তজবাময় করে তোলে।
এবং শহরতলী, গ্রাম
অধিক পবিত্র হয় তোমাদের অন্তিম নিঃশ্বাসে।দুপুর কী এক সুর দিয়েছিলো বুনে
তোমাদের বুকে, সে সুরের সম্মোহনে
বুক দিলে পেতে দ্বিধাহীন শয়তানের হাতের
মতো বন্দুকের মুখে। ব্যারিকেডে, তেতে-ওঠা পিচে,
দেয়ালে, দিগন্তে যেন পুনরায় লাগে
মুক্তিযোদ্ধাদের তাজা শোণিতের ছাপ।
তোমরা যখন শীতদুপুরে রাস্তায়
মৃত্যুর গহ্বরে, হায়, হচ্ছিলে বিলীন,
তখনই তোমরা আরো বেশি উঠলে বেঁচে
স্বদেশের স্পন্দিত হৃদয়ে। তোমাদের জীবনের
শেষ সুর্যাস্তের আভা, দ্যাখো,
আনে আজকের সূর্যোদয়।কবির কলম নয়, রঙধনু দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের এপিটাফ;
সূর্যরশ্মি দিয়ে
জনপথ লেখে তোমাদের স্মৃতিময় জয়গাথা। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |